[Page- 1]
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
তাওহীদ হচ্ছে কোন জিনিসকে এক বলে সাব্যস্ত করা। সুমলিমগণ আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে সাব্যস্ত করেছেন। আর্থাৎ, উপস্যকে তারা এক বলে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি হচ্ছেন পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ। আল্লাহর গ্রন্থে (কুরআনে) কাঙ্ক্ষিত তাওহীদ তিন প্রকার- তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ, তাওহীদে উলুহিয়্যাহ ও তাওহীদে আসমা ওয়াসসিফাত।
তাওহীদে রুবূবিয়্যাহর অর্থ হল, আল্লাহকে তাঁর কার্যাবলীতে এক ও অদ্বিতীয় বলে সাব্যস্ত করা। আল্লাহর কার্য সমূহ অসংখ্য। তন্মধ্যে রয়েছে সৃষ্টি করা, জীবিকা দেয়া, জীবিত করা, মৃত্যুদান করা। পরিপূর্ণতার সাথে এগুলোর একচ্ছত্র অধিপতি হলেন মহান আল্লাহ। তাওহীদে উলুহিয়্যাহ বা ইলাহিয়্যাহ (শব্দ দুটি ألة يألة) ক্রিয়ার ক্রিয়ামূল বা মাছদার। এর অর্থ, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে ইবাদত বা উপাসনা করা; এটি হল বান্দার কার্যাবলীতে আল্লাহকে এক বলে সাব্যস্ত করা। তৃতীয় প্রকার তাওহীদ হচ্ছে, তাওহীদে আসমা ওয়াসসিফাত। এর অর্থ, বান্দার এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহামহিম আল্লাহ তাঁর নাম সমূহ ও গুণাবলীতে একক সত্তা, এ দু‘টিতে তাঁর সমতুল্য আর কেউ নেই।
শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব বিন সুলাইমান আত্-তামীমী (রহিমাহুল্লাহ) এ গ্রন্থে তাওহীদ তিন প্রকার উল্লেখ করেছেন। যে সকল বিষয় মানুষের জন্য অতীব জরুরী এবং যে সকল বিষয়ে তারা কোন বই-পুস্তক পায় না সে সকল বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। আমার উদ্দেশ্য যেমন, তাওহীদে উলুহিয়্যাহ এবং ইবাদত; তিনি এর প্রকার সমূহ বর্ণনা করেছেন। যথা- তাওয়াক্কুল বা ভরসা, ভয়-ভীতি, ভালবাসা…..। এটির বিশদ বিবরণ দানের সময় তার বিপরীত বিষয় শিরকের বর্ণনা দিয়েছেন। শির্ক হচ্ছে মহাপরাক্রমশালী মহীয়ান আল্লাহর সাথে তাঁর প্রভুত্বে অথবা ইবাদত বন্দেগীতে অথবা নাম সমূহ ও গুণাবলীতে অংশীদার সাব্যস্ত করা।
পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে, এক বিবেচনায় শির্ক দু‘ভাগে বিভক্ত- শিরকে আকবার বা সবচেয়ে বড় শির্ক ও শিরকে আসগার বা সবচেয়ে ছোট শির্ক। আবার আর এক বিবেচনায় শির্ক তিন প্রকার- (১) শিরকে আকবার, (২) শিরকে আসগার ও (৩) শিরকে খাফী বা গুপ্ত শির্ক। শিরকে আকবার ইসলামের গণ্ডী থেকে বের করে দেয়। এটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে অন্য কারো ইবাদত করা অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্য করো জন্য ইবাদতের কিছুটা হলেও সম্পন্ন করা, অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করা। শিরকে আসগার সেটিই যেটা শরীয়তদাতার বিচারে শির্ক বলে গণ্য, তবে এটি শিরকে আকবারের একটি হচ্ছে প্রকাশ্যে, যেমন- মূর্তিপূজকদের শির্ক, কবর ও মৃতদের পূজাকারীদের শির্ক। অপরটি হচ্ছে গোপন যেমন- মুনাফিকদের (কপটদের) অথবা গুরু, পীর, ফকীরদের, অথবা মৃতদের অথবা বিভিন্ন উপাস্যের উপর নির্ভরকারীদের শির্ক। এদের শির্কটি গুপ্ত কিন্তু বড়। তবে এটি দৃশ্যত বড় নয়, গোপনেই বড়। শিরকে আসগার যেমন- বালা, সুতা ও তাবীয ব্যবহার করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা। শিরকে খাফী বা গুপ্ত শির্ক হচ্ছে সূক্ষ্ম রিয়াকারী বা প্রদর্শনের ইচ্ছা প্রভৃতি।
وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنۡسَ إِلَّالِيَعۡبُدُونِ ٥٦ (الذّارِيَاتِ)
“আর আমি জ্বিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” ১ [সূরা আয্যারিয়াত- ৫৬] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ
وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍرَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّاغُوتَۖ … ٣٦ (النَّحۡلِ)
“আর আমি তোমাদের প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক।” ২ [সূরা আন্-নাহ্ল- ৩৬] অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُواْ إِلَّا إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَانًاۚ … ٢٣ (الإسراء)
“আর তোমার প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করবে।” ৩ [সূরা আল-ইসরা- ২৩]
قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيْئٗاۖ …١٥١ (الأنعام)
“বলুন, (হে আহলি কিতাব!) তোমরা এসো, তোমাদের প্রভু তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। (তা হচ্ছে) তোমরা কোন কিছুকে তাঁর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না।” ৪ [সূরা আনআম- ১৫১-১৫৩]
وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَاتُشۡرِكُواْ بِهِ شَيۡئًا … ٣٦ (النساء)
“আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না।” ৫ [সূরা- আন্- নিসা- ৩৬] ইবনে মাসুদ (রযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মোহরাঙ্কিত অসিয়াত দেখতে চায়, সে যেন মহান আল্লাহর এ বাণী পড়ে নেয়।
قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡئًاۖ… ١٥١ …. ١٥٢ وأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦ … ١٥٣ (الأنعام)
“হে (মুহাম্মদ) বলো, ‘তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হচ্ছে, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না ……… আর এটাই হচ্ছে আমার সরল, সোজা পথ। অতএব তোমরা এটি অনুসরণ কর; অন্য সকল পথের অনুসরণ কর না।” ৬ [সূরা আনআম- ১৫৩] মুয়ায বিন জাবাল (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
كُنْتُ رَدِيفُ النَّبِى صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ عَلى حِمَارٍ, فَقَالَ لِيْ , يَا مُعَاذً! أَتَدْرِي مَا حَقُّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ , وَمَا حَقٌ الْعِبَادِ عَلى اللهِ؟ قُلْتُ: اَللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمْ؟ قَالَ حَقُّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَّعبُدُوهُ وَلَا يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئَ، وَحَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ أَنْ لَا يُعَذِّبَ مَنْ لَّا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئَا، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ, أَفَلَا أُبَشِّرُ النَّاسَ؟ قَالَ : لَا تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا —
“আমি একটি গাধার পিঠে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পিছনে (আরোহী হয়ে) বসেছিলাম। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘হে মুয়ায! তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক আছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, ‘বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকেই অংশীদার ৭ সাব্যস্ত করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে, যারা তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসুল! এ সুসংবাদ জানিয়ে দেবেন না?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিও না, তাহলে তারা ইবাদত ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে’ (ভুল বুঝে সরিয়তের হুকুম আহকাম মান্য করবে না)।” ৮ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬২৬৭, ২৮৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩০]
১ আল্লাহর বাণীর মর্ম হল: আমি জ্বিন ও মানুষকে অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেনি, শুধু মাত্র একটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। তা হচ্ছে, তারা আমার ইবাদত উপাসনা করবে এ আয়াতে তাওহীদের বর্ণনা রয়েছে। এর যুক্তি হলঃ আমাদের পূর্বসূরিগণ إلَّا لِيَعْبُدُون এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, অর্থাৎ তারা কেবল আমার একত্ববাদে বিশ্বাস করবে। এ ব্যাখ্যার প্রমাণ হলঃ রাসূলগণ কেবল তাওহীদ (একমাত্র আল্লাহর) ইবাদতের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছেন। ইবাদতের উৎপত্তিগত অর্থ হল, বিনয়-নম্রতা। এর সাথে ভালবাসা ও আনুগত্য যুক্ত হলে তা হবে শারয়ী ইবাদত। শারীয়াতের পরিভাষায় ইবাদত অর্থ হলঃ ভালোবাসা, আশা ও ভীতির সমম্বয়ে আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা। শায়খুল ইসলাম বলেছেন, ইবাদত এমন একটি ব্যাপক অর্থবোধক নাম যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় ও সন্তোষজনক সকল প্রকার ও প্রকাশ্য কথা ও কাজ। অতএব এ আয়াতের মর্ম হবে সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই হওয়া ওয়াজিবঃ অন্য কারো জন্য নয়।
২ এ আয়াতটি ইবাদত ও তাওহীদের অর্থের ব্যাখ্যা করছে। আরও ব্যাখ্যা করছে রাসূলগণ তাঁর দু‘টি বাণীসহ প্রেরিত হয়েছেন। সেগুলি হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ‘তাগুত’ থেকে দূরে থাক। এটিই হচ্ছে তাওহীদের মর্মার্থ। اعبدوا الله এ আয়াতাংশে রয়েছে তাওহীদের স্বীকৃতি। و اجتنبوا الطاغوت শিরকের অস্বীকৃতি। الطاغوت শব্দটি فعلوت এর ওজন الطغيان থেকে উৎপন্ন। বান্দা তার উপাসনা ও আনুগত্যের সীমা অতিক্রম করে যারই নিকট ধর্ণা দেয় তাকেই ‘তাগুত’ বলা হয়।
৩ و قضى ربك এর অর্থ হল আদেশ করা ও উপদেশ দেয়া। ألا تعبدوا إلا إياه এর অর্থ হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীতে তাঁর মধ্যে সীমাবদ্ধ কর, অন্যের মাধ্যমে নয়। এটির নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এটিই হচ্ছে لاَ إِله إِلا الله এর অর্থ। আয়াতটি স্পষ্ট যে, তাওহীদের অর্থ হল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদতকে একীভূত করা অর্থাৎ لاَ إِله إِلا الله বাণীটি বাস্তবায়ন করা।
৪ উক্ত বাক্যটি এরূপ, ‘বলুন তোমরা এসো, তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। তিনি তোমাদের উপদেশ দিয়েছেন, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না।’ অর্থাৎ আল্লাহ এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে উপদেশ হল শরীয়তের দৃষ্টিতে, আর আল্লাহর পক্ষ থেকে শরীয়তী উপদেশ হল অপরিহার্য নির্দেশ। পূর্বের আয়াতটির মত এ আয়াতটিও তাওহীদের অর্থ বহন করে।
৫ এ আয়াতে শিরকে আকবার, শিরকে আসগার ও শিরকে খাফী- সকল শির্ক নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া কোন ফিরিস্তা, নবী, নেকার, পাথর, গাছ, জ্বিন প্রভৃতিকে আল্লাহর শরীক করার অনুমতি নেই। কারণ এগুলি সবই ক্ষুদ্র বস্তু (আল্লাহর সৃষ্টি, গায়রুল্লাহ)
৬ ইবনে মাসউদ (রা..) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সা..) -এর মোহরাঙ্কিত উপদেশ প্রত্যক্ষ করতে চায়’ এর তাৎপর্য হল, যদি নেয়া যায় যে, তিনি কিছু উপদেশ দিয়াছেন, এ উপদেশ নামায় সীল মোহর লাগানো হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর পর সেটি খোলা হয়েছে, (অথবা যা এমন আর পরিবর্তন করা যায় না) তাতে এ সব আয়াত রয়েছে যাতে দশটি উপদেশ রয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা..) এর বর্ণনাটি শিরকের নিশেধাজ্ঞা দিয়ে শুরু হওয়া এ সকল আয়াতের উচ্চ মর্যাদা প্রমাণিত করে। হাদীসে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার যোগ্য দাবি, প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
৭ শায়খ বলেন, মুয়ায বিন জাবাল থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি একটি গাধার পিঠে মহানবী (সা..) এর পিছনে বসেছিলাম, তখন তিনি আমাকে বললেন, হে মুয়ায, তুমি কী জান বান্দার উপর আল্লাহর কি হক এবং আল্লাহর উপর বান্দার কি হক? তিনি বলেন, ‘বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না।’ এ হকটি মহান আল্লাহর জন্য একটি ওয়াজিব হক। কারণ কিতাব ও সুন্নাত (মহানবীর অনুপম জীবনাদর্শ) ও সকল রাসূলগণের আগমন ঘটেছে এ হকের দাবি ও বিবরণ নিয়ে এবং এ কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য যে বান্দার উপর সকল ওয়াজিবের মধ্যে বড় ওয়াজিব হল এটি।
৮ এরপর মহানবী (সা..) বলেন, আল্লাহর উপর বান্দার হক হল, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করে না তাকে শাস্তি না দেয়া। আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে এমন একটি হক যেটি আল্লাহ নিজের জন্য নির্ধারিত করেছেন। এতে সমস্ত আলিমগণ এক মত। আল্লাহ তাআ’লা নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী যা চান নিজের জন্য হারাম করেন এবং যা চান ওয়াজিব করেন। হাদীসে কুদসীতে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর যুলুম অবিচারকে হারাম করেছি।’
০১। জ্বিন ও মানব জাতির সৃষ্টির রহস্য।
০২। ইবাদতের মূল তত্ত্বই হচ্ছে তাওহীদ। কারণ, এটা নিয়েই (সৃষ্টির সূচনা হতে) সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব ও মতভেদ।
০৩। যে ব্যক্তি তাওহীদ পন্থী নয় তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করল না, সে কোন ইবাদতই করল না। এতে নিহিত রয়েছে আল্লাহর এ বাণীর তাৎপর্য وَلَآ أَنتُمۡ عَٰبِدُونَ مَآ أَعۡبُدُ ٣ ٱلۡكَافِرُونَ অর্থ- আমি যার ইবাদত করি, তোমরা তার ইবাদত কর না।
০৪। নাবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করার অন্তর্নিহিত হিকমাত বা রহস্য।
০৫। প্রত্যেক জাতির নিকট নাবী-রাসূল প্রেরণের রীতি ব্যাপকভাবে জারি ছিল। [অর্থাৎ সকল উম্মাতই রিসালতের আওতাধীন ছিল।]
০৬। সকল নাবী-রাসূলগণের দ্বীন-জীবন ব্যবস্থা মূলত এক ও অভিন্ন।
০৭। মূল কথা হচ্ছে, তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত সিদ্ধ হয় না। এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা- فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ ٢٥٦ ٱلۡبَقَرَةِ অর্থ- অতঃপর যে তাগুতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনল সে দৃঢ় বন্ধনকে আঁকড়ে ধরল।
০৮। আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয়, সে সব কিছুই সার্বিকভাবে তাগুত হিসেবে গণ্য।
০৯। সালাফে সালেহীনদের কাছে সূরা আন্‘আমের উল্লিখিত তিনটি সুস্পষ্ট আয়াতের উচ্চ মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি বিষয়ের কথা রয়েছে। এর প্রথমটিই হচ্ছে, শির্ক নিষিদ্ধকরণ।
১০। সূরা ইসরায় কতকগুলো সুস্পষ্ট আয়াত রয়েছে এবং এতে আঠারোটি বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। আর আল্লাহ বিষয়গুলোর সূচনা করেছেন তাঁর বাণী- لَاتَجۡعَلۡ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ فَتَقۡعُدَ مَذۡمُومٗا مَّخۡذُولٗا ٢٢ ٱلۡإِسۡرَاءِ অর্থ- ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ সাব্যস্ত কর না, নইলে তুমি নিন্দিত লাঞ্ছিত হয়ে বসে থাকবে।’ এর মাধ্যমে আরও সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন তাঁর বাণী- وَلَا تَجۡعَلۡ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ فَتُلۡقَىٰ فِي جَهَنَّمَ مَلُومٗا مَّدۡحُرًا ٣٩ ٱلۡإِسۡرَاءِ অর্থ- ‘আর তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও আ’ল্লাহর অনুগ্রহ হতে দূরীভূত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ এর মাধ্যমে। সাথে সাথে আল্লাহ তাআ’লা এ বিষয়টির সুমহান মর্যাদাকে উপলব্ধি করার জন্য তাঁর বাণী- ذَٰلِكَ مِمَّآ أَوۡحَىٰٓ إِلَيۡكَ رَبُّكَ مِنَ ٱلۡحِكۡمَةِۗ ٣٩ ٱلۡإِسۡرَاءِ অর্থ- ‘এটি এমন হিকমাতের অন্তর্ভুক্ত যা আপনার প্রতিপালক আপনার নিকট প্রত্যাদেশ করেছেন।’ এর মাধ্যমে আমাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন।
১১। সূরা নিসার ‘আল-হুকুকুল আশারা’ বা ‘দশটি হক বা অধিকার’ নামক আয়াত এর মাধ্যমে এ কথা জানাগেল যে, যার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআ’লার বাণী- وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡئٗاۖ ٣٦ ٱلنَّسَاءِ অর্থ- ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার স্থাপন কর না।’
১২। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্তিম কালে শির্ক হতে বিরত থাকার যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে সতর্কতা ও গুরুত্ব অবলম্বন।
১৩। আমাদের উপর আল্লাহর হক সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
১৪। বান্দা আল্লাহর হক আদায় করলে সে কী হক বা অধিকার লাভ করবে তা জানা।
১৫। [মু’আয বিন জাবাল (রাঃ) বর্ণিত] এ হাদীস টি অধিকাংশ সাহাবীই জানত না।
১৬। কোন বিশেষ কল্যাণের স্বার্থে ‘ইল্ম গোপন রাখার বৈধতা।
১৭। মুসলমানদের আনন্দদায়ক সুসংবাদ দেয়া মুস্তাহাব।
১৮। আল্লাহর অপরিসীম রহমতের উপর ভরসা করে আমল বিমুখ হয়ে পড়ার আশংকা।
১৯। জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি যে বিষয়ে না জানে সে বিষয়ে اللَّهُ وَرَسُوْلُهُ أعْلَمُ অর্থ- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে বেশী জানেন বলা।
২০। ঢালাও ভাবে সকল কে ইল্ম না শিখিয়ে বিশেষ ভাবে কতিপয় লোক কে শেখানোর বৈধতা।
২১। একই গাধার পিঠে পিছনে আরোহণকারী হিসেবে সফর সঙ্গী করার মাধ্যমে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দয়া ও নম্রতা প্রদর্শন।
২২। একই পশুর পিঠে একাধিক ব্যক্তি আরোহণের বৈধতা।
২৩। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) এর মর্যাদা।
২৪। আলোচিত বিষয়টি (তাওহীদের) উচ্চ মর্যাদা ও মহত্ব।
ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يَلۡبِسُواْ إِيمَٰنَهُمۡ بِظُلۡمٍ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ٨٢ (الأَنۡعَامِ)
অর্থ- যারা ঈমান আনবে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম-এর সাথে মিশ্রিত করবে না তাঁদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা। তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। ২ [সূরা আন্’আম- ৮২]
সাহাবী উবাদা বিন সামিত (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
٣٤٣٥ – حَدَّثَنَا صَدَقَةُ بْنُ الفَضْلِ، حَدَّثَنَا الوَلِيدُ، عَنِ الأَوْزَاعِيِّ، قَالَ: حَدَّثَنِي عُمَيْرُ بْنُ هَانِئٍ، قَالَ: حَدَّثَنِي جُنَادَةُ بْنُ أَبِي أُمَيَّةَ، عَنْ عُبَادَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَنْ شَهِدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَأَنَّ عِيسَى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ، وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ، وَالجَنَّةُ حَقٌّ، وَالنَّارُ حَقٌّ، أَدْخَلَهُ اللَّهُ الجَنَّةَ عَلَى مَا كَانَ مِنَ العَمَلِ» قَالَ الوَلِيدُ، حَدَّثَنِي ابْنُ جَابِرٍ، عَنْ عُمَيْرٍ، عَنْ جُنَادَةَ وَزَادَ مِنْ أَبْوَابِ الجَنَّةِ الثَّمَانِيَةِ أَيَّهَا شَاءَ (صحيح البخاري، أحاديث الأنبياء، باب قوله تعالَٰى يَاأَهل الكتاب لا تغلوا فِي دينكم ح:۳۴۳۵ صحيح مسلم، الإيمان، باب الدليل علَٰي أن من مات عَلى التوحيد دخل الجنة قطعًا، ح:۲۸)
‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আ’লাইহিস সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি তাঁর এমন এক কালিমা যা তিনি মারিয়ামে (আ’লাইহিস সাল্লাম) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত রুহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহতাআ’লা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেন। ৩ [বুখারী, হাদীস নং- ৩৪৩৫; মুসলিম, হাদীস নং- ২৮] ইমাম বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক সংকলিত এবং সাহাবী ইতবান বর্ণিত হাদীসে রয়েছে,
((فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّرِ مَنْ قَالَ : لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَٰلِكِ وَجْهَ اللَّهِ)) (صحيح البخاري، باب المساجد في البيوت، ح:۴۲۵، الرقاق، باب العمل الذي يتغى به وجه اللَّه، ح:۶۴۲۳ وصحيح مسلم، المساجد، الرخصة في التخلف عن الجماعة لعذر، ح:۲۶۳\۳۳)
আল্লাহ তাআ’লা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে। ৪ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪২৩; সহীহ মুসলিম, হদীস নং- ৩৩, ২৬৩] প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
((قَالَ مُوْسيٰ عَلَيْهِ السَّلَامُ: يَارَبِّ، عَلَّمْنِي شَيْئًا أَذْكُرُكَ وَأَدْعُوكَ بِهِ، قَالَ: قُلْ يَا مُوْسَىٰ! لَٰا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ، قَالَ: كُلُّ عِبَادِكَ يَقُولُونَ هَذَا، قَالَ: يَا مُوسَىٰ! لَوْ أَنَّ السَّمَٰوَاتِ السَّبْعَ وَعَامِرَهُنَّ غَيْرِي وَالْأَرَضِينَ السَّبْعَ فِي كِفَّةٍ، وَ لَا إِلَٰهَ إلَّا اللَّهُ فِى كِفِّةٍ، مَالَتْ بِهِنَّ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللهُ)) (موارد الظمان إلى زوائد ابن حبان، ح:٢٣٢٤ والمستدرك للحاكم: ١/٥٢٨ ومسند أبي يعلى الموصلي، ح:١٣٩٣)
“মুসা আঃ বলেছিলেন, ‘হে আমার রব, আমাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে ডাকব।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে মুসা, তুমি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল।’ মুসা (আঃ) বললেন, ‘আপনার সব বান্দাই তো এটা বলে।’ তিনি বললেন, হে মুসা, আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা, আর সাত তবক জমিন যদি এক পাল্লায় থাকে আরেক পাল্লায় যদি শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ থাকে, তা হলে ‘লা-ইলাহা ইল্লিল্লাহ’ এর পাল্লাই বেশি ভারি হবে।” [ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ২৩২৪; মুসতাদরাক হাকিম, ১ম খণ্ড ৫২৭; মুসনাদ আবী ইয়ালা, হাদীস নং ১৩৯৩; ইমাম হকিম এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।] বিখ্যাত সাহাবী আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ
((قَالَ اللَّهُ تَبَرَكَ وَتَعَالَى : يَا ابْنَ ءَادَمَ! لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا، ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا، لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً)) (جامع الترمذي، الدعوات، باب ياابن ءادم إنك ما دعوتني، ح:۳۵۴۰)
অর্থ- আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, তুমি যদি আমার নিকট কোন শির্ক না করে পৃথিবী ভর্তি পাপ নিয়ে উপস্থিত হও, তাহলে আমি তোমার নিকট পৃথিবী ভর্তি ক্ষমা নিয়ে আসব।’ ৫ [জামে’ তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৩; ইমাম তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন।]
১ ‘তাওহীদের মর্যাদা এবং এর ফলে যে সকল পাপ মোচন হয়’ অধ্যায় অর্থ তাওহীদ দ্বারা পাপ মোচন হওয়া। বান্দা যত বেশী পরিমাণ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করবে, ততই তার আমলের গুণে সে জান্নাতের পথে ধাবিত হবে তার আমল যাই হোক না কেন। এই কারণে ইমাম সাহেব (রহমাহুল্লাহ) সূরা আন্-আমের আয়াতটি উদ্ধৃত করেছেন।
২ আল্লাহর বাণী- ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يَلۡبِسُواْ إِيمَٰنَهُمۡ بِظُلۡمٍ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ٨٢ (الأَنۡعَامِ) ‘যুলমের অর্থ শির্ক, ইবনে মাসউদ (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে সহীহাইনের হাদীসে এমনই রয়েছে। সাহাবীগণ এখানে এ আয়াতটিকে বিরাট বিষয় ভেবে ফেলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল আমাদের মধ্যে কে নিজের প্রতি যুলুম করেনি?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা যা বুঝেছ তা নয়; যুলুম হল শির্ক। তোমরা কি নেক্কার বান্দার (লোকমানের) কথা শুনো নি?’ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٌ … ١٣ لُقۡمَانَ এ ক্ষেত্রে আয়াতের মর্মার্থ হবে, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে শির্কের সাথে কলুষিত করেনি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা আর তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। আর এটি হচ্ছে তার ফযীলত বা মর্যাদা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যতটুকু শিরকের মাধ্যমে তাওহীদকে কলুষিত করবে তার নিকট থেকে সে হারেই নিরাপত্তা ও হেদায়াত দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি তাওহীদ বাস্তবায়ন করল এবং শিরকের সাথে তার ঈমানকে কলুষিত করে নি অর্থাৎ তার তাওহীদকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করেনি তার জন্য রয়েছে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও হিদায়াত। হাদীসে বর্ণিত মর্মার্থ হল, তার অন্য সব পাপ থাকলেও এবং আমলে ত্রুটি থাকলেও তাওহীদের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জান্নাতে স্থান দিবেন। এটিই হল তাওহীদের অনুসারীদের মর্যাদা।
৩ উবাদা বিন সামিত (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ মর্মে সাক্ষ্য দিবে যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত উপাস্য নেই, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।’ উক্ত হাদীসের শেষ পর্যন্ত, তাঁর অন্য বাণী, مَا كَانَ على অর্থাৎ ‘সে যে আমলের উপরই হোক না কেন’ অর্থাৎ যদিও সে স্বল্প আমলকারী ও অনেক গুনাহ-খাতা করেছে। আর এটাই হল তাওহীদবাদীর প্রতি তাওহীদের আবেদন। ইতবানের বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম আরো এসেছে فَإِنَّ ٱللَّهَ حَرَّمَ بِذَلِكِ وَجۡهَ ٱللَّهِ
৪ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে, এটি হল কালেমায়ে তাওহীদ- তাওহীদের বাণী, আর তাওহীদপন্থী ব্যক্তি যখন তাওহীদের বাণীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, এর শর্তাবলী ও দাবী সমূহ পূরণ করে তখন আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ এবং সাথে কৃত ওয়াদা অনুযায়ী তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দেন। এটি একটি বড় অনুগ্রহ।
কিন্তু যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার পরও অন্যান্য পাপ করে তওবা না করে মারা যায় তার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ চাইল তাকে শাস্তি দিবেন এরপর তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দিবেন। অর্থাৎ শাস্তি ভোগ করার পর আবার ইচ্ছে করলে তাকে ক্ষামাও করতে পারেন। তার জন্য প্রথমেই জাহান্নামকে হারাম করে দিতে পারেন।
৫ এ হদীসের তাৎপর্য হল, বান্দার পাপ যদি সাত আকাশ, আকাশে অবস্থিত বান্দা ও ফিরিশতা এবং সাত জমিন পরিমাণও হয় তাহলে সেগুলোর চেয়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর পাল্লাটি ভারি হবে’। আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) এর হাদীসেও এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। কালিমায়ে তাওহীদের এ বিরাট ফযীলত ঐ ব্যক্তির জন্য যে একনিষ্ঠ ভাবে নিখাদ চিত্তে সত্যিকার অর্থে এটি গ্রহণ করে, বিশ্বাস করে, এটিকে ভালবাসে অন্তরে কালেমার ছাপ ও চিহ্ন তার আলো প্রভাবিত করে। যে তওহীদের স্বরূপ এমন হবে, সেটি তাওহীদ বিরোধী সকল পাপকে ভস্মীভূত করে ফেলে।
০১। আল্লাহর অসীম করুণা।
০২। আল্লাহর নিকট তাওহীদের পুরস্কারের আধিক্য।
০৩। তাওহীদের বদৌলতে পাপরাশি মোচন হয়।
০৪। সূরা আনআ’মের (পূর্বোল্লিখিত ৮২ নং) আয়াতের তাফসীর [অর্থাৎ শির্কই প্রকৃত যুল্ম]
০৫। উবাদা বিন সামিত (রাযিআল্লাহু আনহু)- এর হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের তাৎপর্য অনুধাবন করা।
০৬। উবাদা বিন সামিত (রাযিআল্লাহু আনহু) এবং ইতবান (রাযিআল্লাহু আনহু)- এর হাদীস একত্রিত করলে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ- এর অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং ধোঁকায় নিপতিত লোকদের ভুল সুস্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।
০৭। ইতবান (রাযিআল্লাহু আনহু)- এর হাদীসে যে শর্ত রয়েছে [শর্তটি হল, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তাওহীদের কালিমা পাঠ করবে।], সে সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
০৮। নাবী ও রাসূলগণও [যেমন- মুসা (আঃ)] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ- ফযীলত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য মুখাপেক্ষী ছিলেন।
০৯। সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় এ কালিমার পাল্লা ভারী হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ, যদিও এ কালেমার অনেক পাঠকের পাল্লা ইখলাসের সাথে [অন্তর হতে] পাঠ না করার কারণে নেকীর পাল্লা হালকা হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে।
১০। সপ্তাকাশের মতো সপ্ত জমিনও বিদ্যমান থাকার প্রমাণ।
১১। জমিনের মতো আকাশেও বসবাসকারীর অস্তিত্ব আছে।
১২। আশআ’রীদের মতবাদকে খণ্ডন করে আল্লাহর গুণাবলীকে ইতিবাচক বলে সাব্যস্ত করা। [অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা নিগুর্ণ নন, তিনি বহু গুণে ভূষিত।]
১৩। সাহাবী আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু)-এর হাদীস সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর ইতবান (রাযিআল্লাহু আনহু) এর হাদীসে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এর বাণী, ‘আল্লাহ তাআ’লা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে।’-এর মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হয়। আর তা হচ্ছে, শির্ক বর্জন করা। মূল কথা হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ শুধু মুখে উচ্চারণ করলেই শার্ক পরিত্যাগ করা হয় না।
১৪। ঈসা (আ’লাইহিস সাল্লাম) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উভয়েই আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি গভীর ভাবে অনুধাবন করা।
১৫। ঈসা (আ’লাইহিস সাল্লাম)-কে কালিমাতুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়া।
১৬। ঈসা (আ’লাইহিস সাল্লাম) আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ (পবিত্র আত্মা)-এর কথা জানা।
১৭। জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস রাখার মর্যাদা।
১৮। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী, (যে ব্যক্তি অন্তর হতে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, সে যে আমলই করুক না কেন জান্নাতে যাবে।)-এ কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করা।
১৯। মীযানের দু‘টি পাল্লা আছে, এ কথা জানা।
২০। হাদীসে বর্ণিত, আল্লাহর সত্তার জন্য وجه (ওয়াজহ) বা চেহারা-মুখমণ্ডল আছে, আল্লাহর এ গুণ- চেহারার প্রতি ঈমান রাখতে হবে, তবে তাঁর কোন সৃষ্টির সাথে তুলনা করা যাবে না।
إِنَّ إِبۡرَٰهِيمَ كَانَ أُمَّةٗ قَانِتٗا لِّلَّهِ حَنِيفٗا وَلَمۡ يَكُ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٢٠ (النحل)
“নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মাত বিশেষ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।” ২ [সূরা আন-নাহ্ল- ১২০] আল্লাহ বলছেনঃ
وَٱلَّذِينَ هُمۡ بِرَبِّهِمۡ لَايُشۡرِكُونَ ٥٩ (مُؤۡمِنُونَ)
“আর যারা তাদের রবের সাথে কোন অংশীদার সাব্যস্ত করে না” ৩ [সূর আল-মুমিনুন- ৫৯] হুসাইন বিন আব্দুর রহমান (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, একবার আমি সাঈদ বিন জুবাইরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, গতকাল রাত্রে যে নক্ষত্রটি ছিটকে পড়েছে তা তোমাদের মধ্যে কে দেখতে পেয়েছে? তখন বললাম, আমি। তারপর বললাম, ‘বিষাক্ত প্রাণী কর্তৃক দংশিত হওয়ার কারণে আমি সালাতে উপস্থিত থাকতে পারিনি’। তিনি বললেন, তখন তুমি কি চিকিৎসা করেছ? বললাম, ‘ঝাড় ফুঁক করেছি’। তিনি বললেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? [অর্থাৎ তুমি কেন এ কাজ করলে?] বললাম, ‘একটি হাদীস’ [এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে।] যা শা’বী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছে। তিনি বললেন, তিনি তোমাদের কি বর্ণনা করেছেন? বললাম ‘তিনি বুরাইদা বিন আল হুসাইব থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, ‘চোখের দৃষ্টি বা চোখ লাগা এবং জ্বর ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়-ফুঁক নেই।’ তিনি বলেন, ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কাজ করেছে, যে শ্রুত জিনিস শেষ পর্যন্ত আমল করতে পেড়েছে। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রাযিআল্লাহু আনহু) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেনঃ
((عُرِضَتْ عَلَيَّ الأُمَمُ، فَرَأَيْتُ النَّبيَّ وَمَعَهُ الرَّهْطُ، وَالنَّبِيَّ وَمَعَهُ الرَّجُلُ وَالرَّجُلَانِ، وَالنَّبِيَّ وَلَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ، إِذْ رُفِعَ لِي سَوَادٌ عَظِيمٌ، فَظَنَنْتُ أَنَّهُمْ أُمَّتِي، فَقِيلَ لِي: هٰذَا مُوسٰى وَقَوْمُهُ، فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ، فَقِيلَ لِي: هٰذِهِ أُمَّتُكَ، وَمَعَهُمْ سَبْعُونَ أَلْفًا يَّدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَّلَا عَذَابٍ، ثُمَّ نَهَضَ فَدَخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ فِي أُولٰئِكَ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ صَحِبُوا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ وُلِدُوا فِي الْإِسْلَامِ فَلَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا، وَذَكَرُوا أَشْيَاءَ، فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرُوهُ فَقَالَ: هُمُ الَّذِينَ لاَ يَسْتَرْقُونَ وَلَا يَكْتَوُونَ وَلَا يَتَطَيَّرُونَ، وَعَلٰى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ، فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ: أُدْعُ اللهَ أَنْ يَّجْعَلَنِي مِنْهُمْ، قَالَ: أَنْتَ مِنْهُمْ، ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ ءَآخَرُ فَقَالَ: أُدْعُ اللَّهَ أَنْ يَّجْعَلَنِي مِنْهُمْ، فَقَالَ: سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ)) (صحيح البخاري، الطب، باب من اكتوى أو كوى غيره وفضل من لم ۵۷۵۲ وصحيح مسلم، الإيمان، باب الدليل على دخول طوائف، ح: ۲۲۰، واللفظ له)
“আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হল। তখন আমি এমন একজন নাবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এরপর আরো একজন নাবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে মাত্র দু‘জন লোক রয়েছে। আবার একজন নাবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেই। ঠিক এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জনগোষ্ঠী পেশ করা হল। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল এরা হচ্ছে মুসা (আঃ) এবং তাঁর জাতি। এরপর আরো একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালাম। তখন আমাকে বলা হল, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তর হাজার লোক রয়েছে যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আজাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথা বলে তিনি দরবার থেকে উঠে বাড়ির অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করে দিল। কেউ বলল, তারা বোধ হয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহচার্য লাভকারী ব্যক্তিবর্গ। আবার কেউ বলল, তারা বোধ হয় ইসলাম পরিবেশে অথবা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে তারা কাউকে শরিক করেনি। তারা এ ধরণের আরও কথা বলাবলি করল। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হল। তখন তিনি বললেন, ‘তারা হচ্ছে ঐ সব লোক যারা ঝাড়-ফুক করে না। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করে না। শরীরে সেক বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে।’ এ কথা শুনে ওয়াকাশা বিন মুহসিন দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি আমার জন্য দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা‘আলা আমাকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দল ভুক্ত করে নেন। ‘তিনি বললেন আমি দুআ’ করলাম, ‘তুমি তাদের দলভুক্ত।’ অতঃপর অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দোয়া করুন যেন তিনি আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেন। তিনি বললেন, ‘তোমার পূর্বেই ওয়াকাশা অগ্রবর্তী হয়ে গেছে।” ৪ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭৫২, ৫৭০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২২০]
১ তাওহীদের বর্ণনার ক্ষেত্রে এ অধ্যায়টি সর্বোচ্চ স্তরের। কারণ, তাওহীদের ফযীলতে তাওহীদপন্থীরাও জড়িত। এ উম্মতের বিশিষ্ট ব্যক্তগণই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাওহীদের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে এ অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়।
২ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকারী ছিলেন। তার প্রমাণ হল, আল্লাহ তাকে কয়েকটি গুণে ভূষিত করেছেন। প্রথম- তিনি এক (أمة জাতি) ছিলেন। উম্মাত হচ্ছেন সেই ইমাম যিনি কল্যাণ ও মানবিক ও মানবিক পরিপূর্ণতার সকল গুণে গুণান্বিত। এর অর্থ হল তার মধ্যে কোন কল্যাণের ঘাটতি ছিল না। এটাই হল তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আর্থ। দ্বিতীয়ত- এতে আনুগত্য ও তাওহীদপন্থীদের বরণ কারা সাব্যস্ত। (قَانِتًا لِلَّهِ) এতে মুশরিকদের পথ এবং তাদের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া প্রমাণিত হয়। সেই পথ হল শির্ক ও বিদাত ও অবাধ্যতার পথ।* এই তিনটি হচ্ছে মুশরিকদের চরিত্র। তারা আনুগত্য করে না, তাওবা করে না।
৩ (وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ) আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে, তারা কোন অবস্থাতেই বড় ছোট ও গুপ্ত শির্ক এ লিপ্ত হয় না। এবং মুশরিক থেকে দূরে থাকে। শায়খ (রাহেমাহুল্লাহ) এ সমস্ত অর্থ আয়াত থেকেই উপস্থাপিত করেছেন। আয়াতের অর্থ হল, আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা এসব বর্জন করেন। আর আল্লাহর বাণীঃ (وَلَّذِينَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لَا يُشْرِكُونَ) শির্কের অস্বীকৃতি বুঝায়। কেননা নিয়ম হল (فعل مضارع) এর উপর যদি حرف نفى আসে তবে তাতে উক্ত فعل ক্রিয়ার মাসদারের عمل نفى এর ফায়দা দেয় অর্থাৎ তিনি যেন বলেন, না তারা মহা শিরক করে, না ছোট শিরক, না গুপ্ত শির্ক অর্থাৎ তারা কোন প্রকার শির্ক করে না। আর যে শির্ক করে না সেই হল তাওহীদপন্থী। আর সে ব্যক্তি এ জন্যই শির্ক করে না, কেননা সে তাওহীদপন্থী। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহর বাণীতেঃ بربهم কে পূর্বে আনার কারণ হল, তাওহীদে রুবুবিয়্যাত ও তাওহীদে উলুহিয়্যাত পরস্পর জড়িত। আর এটি ঐ লোকদেরই বৈশিষ্ট্য যাঁরা তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করে কেননা শির্ক না করাতে এটাও জরুরী হয় পড়ে যে, সে তার প্রবৃত্তির সাথেও শির্ক করবে না, যখন কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির সাথে শির্ক করে তখন সে বিদাতে পিতিত হয় বা পাপে লিপ্ত হয়। সুতরাং শির্ক পরিত্যাগের ফলে সমস্ত প্রকার শির্ক বিদাআ’ত ও পাপ পরিত্যাগ হয়ে থাকে। আর একেই বলা হয় আল্লাহ তাআ’লার জন্য তাওহীদ প্রতিষ্ঠা।
৪ হাদীসের অর্থটা এমন নয় যে, যারা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করে তারা মোটেও কোন চিকিৎসা গ্রহণ করে না। কারণ মহানবীকে ঝাড়ফুঁক করা হয়েছে, তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং এর নির্দেশ দিয়েছেন এবং একজন সাহাবীকে দাগ দেয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে এধারণা করা যায় না যে, তাঁরা চিকিৎসা ও ঔষধকে আরোগ্য লাভের একেবারে কারণ হিসেবে গ্রহণ করেননি। হাদীসে যে তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, এগুলোর ফলে আল্লাহর উপর ভরসা কমে যায় এবং তাতে হৃদয়ের সম্পর্কে ও আকর্ষণ ঝাড়-ফুঁককারী, সেকদাতা ও গণকের দিকে ধাবিত হয়। যাতে আল্লাহর প্রতি ভরসা কমতি হয়। পক্ষান্তরে চিকিৎসা ওয়াজিব অথবা মুস্তাহব। কোন কোন অবস্থায় মুবাহ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা চিকিৎসা কর; হারামের মাধ্যমে চিকিৎসা করো না।’
০১। তাওহীদের ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান সম্পর্কিত জ্ঞান।
০২। তাওহীদ বাস্তবায়নের মর্মার্থ কি তা জানা।
০৩। আল্লাহ তাআ’লা নাবী ইবরাহীম (আঃ) এর [বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা] এ কথা বলে প্রশংসা করেছেন যে, তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
০৪। শির্ক থেকে মুক্ত থাকার কারণে বড় বড় বুজুর্গ ব্যক্তিগণের প্রশংসা।
০৫। তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক ও চর্ম দগ্ধ (আগুনের দাগ) নেয়া বর্জন করা তাওহীদপন্থী হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
০৬। আল্লাহর উপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহ নির্ভরতাই বান্দার মধ্যে উল্লিখিত গুণ ও স্বভাব সমূহের সমাবেশ ঘটায়।
০৭। বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশকারী সৌভাগ্যবান লোকরা কোন আমল ব্যতীত উক্ত মর্যাদা লাভ করতে পরেননি, এটা জানার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের জ্ঞানের গভীরতা।
০৮। কল্যাণের প্রতি তাঁদের অপরিসীম আগ্রহ।
০৯। সংখ্যা ও গুণাবলীর দিক থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর সার্বিক ফযীলত বা মার্যাদা।
১০। মুসা (আঃ) এর অনুসারীদের (অর্থাৎ সাহাবীদের) মর্যাদা।
১১। সব উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।
১২। প্রত্যেক উম্মাতই নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথক ভাবে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে।
১৩। নবীগণের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মতো লোকের স্বল্পতা।
১৪। যে নবীর দাওয়াত কেউ গ্রহণ করেনি, তিনি একাই হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন।
১৫। এ জ্ঞানের শিক্ষা হচ্ছে, সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ধোঁকা না খাওয়া আবার সংখ্যাল্পতার কারণে অবহেলা না করা।
১৬। চোখ-লাগা (বদনজর লাগা), বিষাক্ত জীবের দংশনজনীত বিষে ও জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি রয়েছে। [তবে, শর্ত হচ্ছে, স ঝাড়-ফুঁকে শিরকের লেশমাত্রও যেন না থাকে।]
১৭। সালফে সালেহীনের জ্ঞানের গভীরতা قد أحسن من انتهى إلى ما ‘সে ব্যক্তি উত্তম কাজ করেছে, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে যা শুনেছে তাই আমল করেছে।’ কিন্তু এ সব কাজ [ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্র, তাবীয-কবচ ইত্যাদির আশ্রয় না নিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে আল্লাহর উপর নির্ভর করা।] আরো বেশী কল্যাণদায়ক, এ কথাই এর প্রমাণ বহন করে। অতএব, প্রথম হাদীস দ্বিতীয় হাদীসের বিরোধী নয়।
১৮। সালফে সালেহিনদের স্বভাবসিদ্ধ রীতি ছিল এরূপ যে, মানুষের মধ্যে যে গুণ নেই তার প্রশংসা থেকে বিরত থাকতেন।
১৯। أنت منهم – (তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত) বলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াকাশা (রাঃ) এর ব্যাপারে যে সুসংবাদ প্রদান করেছেন, তা নবুওয়াতেরই প্রমাণ পেশ করে। [এটি মাহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যতম একটি মুজিযা, কারণ এটি কোন ভবিষ্যদ্বাণী নয়।]
২০। ওয়াকাশা (রাঃ) এর মর্যাদা ও ফযীলত।
২১। কোন কথা সরাসরী না বলে হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা। [অর্থাৎ ইঙ্গিত ও কৌশল প্রয়োগ, যেমন- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বিতীয় বার দু’আর আবেদনকারীকে সরাসরি বলেননি যে, আমি তোমার জন্য দু’আ করব না, বরং তিনি কথাটি অন্যভাবে বললেন যে, ‘তোমার পূর্বেই ওয়াকাশা এ ব্যাপারে অগ্রবর্তী হয়ে গেছে।’]
২২। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুপম চরিত্র।
إِنَّ ٱللَّهَ لَايَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَادُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَّشَآءُۚ … ٤٨ (النساء)
অর্থ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করার গুনাহ ক্ষমা করেন না, তা ব্যতীত যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” ১ [সূরা নিসা- ৪৮] ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ) বলেছিলেনঃ
وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ (ابراهيم)
“আমাকে ও আমার বংশধরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ।” ২ [সূরা- ইবরাহীম- ৩৫] এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
((أَخْوَفُ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ، فَسُئِلَ عَنْهُ فَقَالَ: الرِّيَاءُ)) (مسند أحمد: ۴۲۸/۵، ۴۲٩ ومجمع الزوائد: ۱۰۲/۱ والمعجم الكبير للطبر اني، ۴۳۰۱ بزيادة إِنَّ في أوله)
অর্থ- “আমি তোমাদের জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী ভয় করি, তা হচ্ছে শিরকে আসগার অর্থাৎ ছোট শির্ক। তাঁকে শিরকে আসগার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, (ছোট শির্ক হচ্ছে) রিয়া বা প্রদর্শন ইচ্ছা।” ৩ [আহমদ, ৫ম খণ্ড ৪২৮; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১ম খণ্ড ১০২; মু’জামুল কাবীর ত্বাবরানী, হাদীস নং ৪৩০১] ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
((مَنْ مَّاتَ وَهُوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ)) (صحيح البخاري، التفسير، باب قوله تعالى ﴿ومن الناس من يتخذ من دون اللَّه أندادا﴾ ح:۴۳٩۷)
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” ৪ [বুখারী, হাদীস নং ৪৪৯৭] সাহবী জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
((مَنْ لَّقِيَ اللَّهَ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَّقِيَهُ يُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ)) (صحيح مسلم، الإيمان، باب الدليل على من مات لا يشرك باللَّه شيئا دخل الجنة وأن من مات مشركًا دخل النار، ح:٩۳)
অর্থ- “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” ৫ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৩]
* তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকারীগণ তাওহীদের পথে চলার সাথে সাথে শির্ক কে ভয় করেন। যে ব্যক্তি শিরকে ভয় করে সে শিরকের অর্থ ও তার প্রকার সমূহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে যাতে এগুলোয় পতিত না হয়।
১ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ কতিপয় বিদ্যান বলেন, এখানে ছোট, বড় ও গোপন সকল শির্ক উদ্দেশ্য। শির্ক এতই ভয়াবহ যে, তাওবা ছাড়া আল্লাহ এগুলো ক্ষমা করেন না। কারণ তিনি সৃষ্টি করেছেন, জীবিকা দিয়েছেন দান ও আনুগ্রহ করেছেন। অতএব কিভাবে মন অন্য দিকে ধাবিত হতে পারে? এ ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাই্য়্যিম, মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ও অধিকংশ বিদ্বান। অতএব যখন কোন শিরকই ক্ষমা করা হবে না সুতরাং তা থেকে ভয় করা অপরিহার্য। আর শির্ক হল সবচেয় ভয়ঙ্কর। আর যেহেতু রিয়া লৌকিকতা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের প্রতি সম্পর্কিত করা ইত্যাদি যখন শির্ক, আর আর তা ক্ষমা করা হবে না। সুতরাং তা থেকে এবং মহা শির্ক থেকেও সবচেয়ে বড় ভয় করা অপরিহার্য। শির্ক যেহেতু মানুষের অন্তরে সৃষ্টি হয়ে থাকে অতএব, মানুষের উচিত শিরকের যাবতীয় প্রকার সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা, যেন তাতে পতিত না হয়। অতঃপর শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ ঐ আয়াত বর্ণনা করেন যাতে ইবরাহীম (আঃ) এর দুআ’ রয়েছে وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ
২ এটি হচ্ছে মর্দে কামালের অবস্থা। তারা শুধু তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হন না, বরং শির্ক ও তার মাধ্যকেও ভয় করেন। اصنام শব্দটি صنم এর বহুবচন। আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত-পূজা করা হয় তার ছবি ও প্রতিকৃতিকে صنم বলে। তাই সেটি মানুষের চেহারার আকারে হোক বা প্রাণীর শরীর বা মাথা ইত্যাদির আকারে হোক, চাঁদ, সূর্য, কবর অথবা অন্য যে কোন আকারেই হোক। الوثن ‘অসান’ হল, আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয়, চাই তা ছবির আকৃতিতে হোক যা আসনামের-মূর্তির অন্তর্ভুক্ত, অথবা ছবির আকৃতির না হোক যেমন- কবর, মাজার।
৩ রিয়া সম্পর্কে মানুষ অসচেতন এবং আল্লাহ্ এটি ক্ষমা করেন না, তাই মহানবী (সাঃ) এ বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন। রিয়া দুই প্রকার, যেমন- (ক) মুনাফিকদের রিয়া। অর্থাৎ মুখে ইসলাম প্রকাশ করে আল অন্তরে থাকে কুফরী। يُرَآؤُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَليلًا – অর্থাৎ “তারা লোকদেরকে দেখায় আর তারা অতি অল্পই আল্লাহকে স্মরণ করে।” (খ) তাওহীদপন্থী মুসলমানের রিয়া। যেমন- খুব সুন্দর করে সালাত আদায় করে যাতে মানুষ তা দেখে প্রশংসা করে। এটি ছোট শির্ক।
৪ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে ডাকা বড় শির্ক। সহীহ হাদীসে আছে, “দুআ’ বা প্রার্থনাই ইবাদত।” যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো জন্য ইবাদতের কিছু অংশ সাব্যস্ত করল সে নিজের জন্য জাহান্নামকে ওয়াজিব করে নিল। নবীর বাণীঃ دخل النار অর্থাৎ যেমন কাফিরদের অবস্থান জাহান্নামে চিরস্থায়ী অনুরূপ তার অবস্থাও। কেননা মুসলমান যদি মহা শিরকে পতিত হয় তবে তার আমন নষ্ট হয়ে যাবে, যেমন আল্লাহ তাআ’লা তাঁর নাবীকে বলেনঃ وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَسِرِيْنَ “আর তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে নিশ্চয়ই তোমার কৃতকর্ম নষ্ট হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পরবে।” (সূরা যুমার- ৬৫) হাদীসে বর্ণিত শব্দ من دون الله এর তফসীরকারক ও দ্বীনি গবেষকদের মতে তাফসীর হল, যে আল্লাহকে ডাকে ও আল্লাহর সাথে অন্যকে ডাকে এবং যে আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ডাকে ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার দিকেই ধাবিত হয়।
৫ হাদীসের আর্থ হল, যে ব্যক্তি কোন ধরণের শির্ক করল না এবং (আল্লাহকে বাদ দিয়ে) কারো মুখাপেক্ষী হল না, না কোন ফিরিশতা আর না কোন নবী, না কোন ওলী ও না কোন জ্বিনের, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহে জান্নাতে প্রবেশের ওয়াদা দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শির্ক করা অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এখানে মহা শির্ক, ছোট শির্ক গোপন শির্ক সবই অন্তর্ভুক্ত। শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি কি সাময়িক ভাবে না স্থায়ী ভাবে জাহান্নামে থাকবে? (ক) বড় শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। সেখান থেকে বের হবে না। (খ) আর ছোট ও গোপন শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি কিছুকাল জাহান্নামে থাকার পর বের হয়ে আসবে; কারণ সে তাওহীদপন্থী।
০১। শির্ক-ভীতি, শিরককে ভয় করে চলতে হবে।
০২। ‘রিয়া’ বা ‘প্রদর্শনের ইচ্ছা’ বা লোক দেখান আমল ‘শিরকের’ অন্তর্ভুক্ত।
০৩। ‘রিয়া’ ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
০৪। নেক্কার লোকদের জন্য সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে ‘শিরকে আসগর’ (ছোট শির্ক)।
০৫। জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটেই আছে। [অর্থাৎ উভয়েই নিকটে রয়েছে, দূরে নয়।]
০৬। জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি একই হাদীসে বর্ণিত হওয়া।
০৭। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক সাব্যস্ত করে মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তি মানুষের মধ্যে সর্বাধিক ইবাদতকারী হওয়া সত্ত্বেও সে জাহান্নামে যাবে।
০৮। ইবরাহীম খলিল (আঃ) এর দুআ’র প্রধান বিষয় হচ্ছে, তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা তথা শির্ক থেকে রক্ষা করা।
০৯। رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرَا مِّنَ النَّاسِ “হে আমার রব, এ মূর্তিগুলো বহু লোককে গুমরাহ করেছে” এ কথা দ্বারা ইবরাহীম (আঃ) বহু লোকের অবস্থা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করেছেন।
১০। এতে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর তফসীর রয়েছে, যা ইমাম বুখারী (রাহি) বর্ণনা করেছেন।
১১। শির্ক থেকে মুক্ত ব্যক্তির মর্যাদা।
قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَاْ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ وَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَمَآ أَنَاْ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٠٨ (يوسف)
অর্থ- “বলুন, এটি আমার পথ। আমি জেনে বুঝে আল্লাহর দিকে আহবান করি।” ২ [সূরা ইউসুফ- ১০৮] সহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, সাহাবী মুআ’য বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূল (সাঃ) যখন ইয়ামানের শাসনকর্তা নিয়োগ করে পাঠালেন তখন [রাসূল (সাঃ) সাহাবী মুআ’যকে লক্ষ্য করে] বললেনঃ
((إِنَّكَ تَأْتي قَوْمًا مِّنْ أَهْلِ ٱلْكِتَابٍ، فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ شَهَادَةُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَفِي رِوَايَةٍ: إِلٰى أَنْ يُّوَحِّدُوا اللهَ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوكَ لذٰلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَّلَيْلَةٍ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوكَ لِذٰلِكَ، فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ على فُقَرَائِهِمْ، فَإِنَّ هُمْ أَطَاعُوكَ لِذٰلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ، وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ)) (صحيح التخاري، الزكاة، باب لا توخذ كرائم أموال الناس فِي الصدقة، ح:۱۴۵۸، ۱۴۹۶، ۳۴۴۸، ۴۳۴۷، ۷۳۷۲ وصحيح مسلم، الإيمان، باب الدعاء إلى الشهادتين وشرائع الإسلام، ح:۱۹)
“তুমি এমন এক কাওমের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। [যারা কোন আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী] কাজেই সর্ব প্রথম যে জিনিসের দিকে তুমি তাদেরকে আহ্বান জানাবে তা হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এর সাক্ষ দান। অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান। এ বিষয়ে তারা যদি তোমার আনুগত্য করে, তবে তাদেরকে জানিয়ে দিয়ো যে, আল্লাহ তাআ’লা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দিয়েছেন। এ ব্যপারে তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয়, তবে তাদেরকে জানিয়ে দিয়ো যে, আল্লাহ তাআ’লা তাদের উপর জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরিবদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে, তবে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধান থাকবে। আর মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করে চলবে। কেননা মজলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তাআ’লার মাঝখানে কোনই পর্দা নাই।” ৩ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৫৮, ১৪৯৬, ২৪৪৮, ৪৩৪৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯] বুখারী ও মুসলিমে সাহাল বিন সাআদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) খায়বারের (যুদ্ধের) দিন বললেনঃ
((لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَدًا رَّجُلًا يُّحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ، وَيُحِبُّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ، يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَٰى يَدَيْهِ، فَبَاتَ النَّاسُ يَدُوكُونَ لَيْلَتَهُمْ أَيُّهُمْ يُعْطَاهَا، فَلَمَّا أَصْبَهُوا غَدَوْا عَلَٰى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّىٰ اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم، كُلُّهُمْ يَرْجُو أَنْ يُّعْطَاهَا، فَقَالَ: أَيْنَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ؟ فَقِيلَ: هُوَ يَشْتَكِي عَيْنَيْهِ، فَأَرْسَلُوا إِلَيْهِ فَأُتِيَ بِهِ، فَبَصَقَ فِي عَيْنَيْهِ وَدَعَا لَهُ، فَبَرَأَ كَأَنْ لَّمْ يَكُنْ بِهِ وَجَعٌ، فَأَعْطَاهُ الرَّايَةَ، فَقَالَ: انْفُذْ عَلَىٰ رِسْلِكَ حَتَّى تَنْزِلَ بِسَاحَتِهِمْ ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الإِسْلَامِ، وَأَخْبِرْهُمْ بِمَا يَجِبُ عَلَيْهِمْ مِّنْ حَقِّ اللَّهِ تَعَالَىٰ فِيهِ، فَوَاللَّهِ لَأَنْ يَّهْدِيَ اللَّهُ بِكَ رَجُلًا وَّاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ)) (سحيح البخاري، فضائل أصحاب النبيي صلى اللَّهُ عليه وَسلم، باب مناقب علي بن أبي طالب رَضي اللَّهُ عَنْهُ، ح:۳۷۰۱ وصحيح مسلم، فضائل الصحابة، باب علي بن أبي طَالب رضي اللَّهُ عنه ح:۲۴۰۶)
অর্থ- “আগামীকাল এমন ব্যক্তির কাছে আমি ঝাণ্ডা প্রদান করব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাকে ভালবাসেন। তার হাতে আল্লাহ তাআ’লা বিজয় দান করবেন। কাকে ঝাণ্ডা প্রদান করা হবে এ উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতার মধ্যে লোকজন রাত্রি যাপন করল। যখন সকাল হয়ে গেল তখন লোকজন রাসূল এর নিকট গেল, তারা প্রত্যেকে আশা পোষণ করছিল যে, ঝাণ্ডা তাকেই দেয়া হবে। [অর্থাৎ যদি আমি ঝাণ্ডা পেতাম! এ রকম একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রত্যেকের অন্তরে।] তিনি (সাঃ) বললেন, আলী বিন আবি তালিব কোথায়? বলা হল, তিনি চক্ষুর পীড়ায় ভুগছেন। তাদেরকে আলী (রাঃ) এর কাছে পাঠান হল। অতঃপর তাকে রাসূল (সাঃ) এর নিকট নিয়ে আসা হল। তিনি আলী (রাঃ) এর চোখে নিজের মুখের পবিত্র থুতু দিলেন এবং তার জন্য দু’আ করলেন। তখন তিনি এমন ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন যেন তার চোখে কোন ব্যথাই ছিল না। রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ) এর হাতে পতাকা তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি বীর পদক্ষেপে [ভয়হীন চিত্তে] ভিতর ঢুকে পড়। এমন কি তাদের [দুশমনদের] নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হও। তারপর তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাও এবং তাদের উপরে আল্লাহ তাআ’লার যে সব হক রয়েছে সে সম্পর্কে তাদের যা করণীয় তা জানিয়ে দাও। আল্লাহর কসম তোমার দ্বার যদি আল্লাহ তাআ’লা একজন মানুষকেও হিদায়াত দান করেন তাহলে সেটা হবে তোমার জন্য লাল উটের চেয়েও উত্তম।” ৪ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৭০১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৪০৬]
১ মানুষকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিলে, শির্ক ভীতি পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং তাওহীদও পরিপূর্ণতা লাভ করে। এটিই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এর প্রকৃত স্বরূপ। কেননা এর আর্থ হল, তার আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও তার দাবি সম্পর্কে অন্যকে জানান। তাওহীদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য হল তার সঠিক দিক ও প্রকারের প্রতি দাওয়াত দেওয়া এবং শির্ক ও শিরকের প্রকারসমূহ থেকে নিষেধ করা আর এটিই হল সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২ একমাত্র আল্লাহর দিকে অন্য কারো দিকে নয়। আল্লাহর এ বাণীতে দুটি উপকারিতা রয়েছে, (ক) তাওহীদের প্রতি আহ্বান। (খ) খুলুসিয়াত সম্পর্কে সচেতনতা। কেননা, যদিও অনেকে হকের পথে আহ্বান করে কিন্তু বাস্তবে সে নিজের দিকে আহ্বান করে থাকে। على بصيرة অর্থাৎ তাওহীদের দিকে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস জ্ঞান ও বুঝের মাধ্যমে আহ্বান করেন বরং আল্লাহর পথে না জেনে না বুঝে দাওয়াত দেন না। أنا ومن اتبعنى এর অর্থ হল আমি আল্লাহর পথে জেনে বুঝে আহ্বান করি এবং আমার যারা অনুসারী ও যারা আমার দাওয়াত কবুল করেছে তারাও সে পথে জেনে বুঝে দাওয়াত দেয়। সুতরাং নবীগণের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা শুধু শিরকের ভয় এবং তাওহীদকে বাস্তবায়ন করেই ক্ষান্ত হন না বরং তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেন।
৩ হদীসটি থেকে দলীল গ্রহণের কারণ হল, নবী (সাঃ) মুয়ায (রাঃ) কে দাওয়াতের জন্য পাঠিয়ে নির্দেশ দেন যে, তাঁর দাওয়াত যেন সর্বপ্রথম ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এর সাক্ষ্যের প্রতি হয়। এর ব্যাখ্যা রয়েছে অন্য বর্ণনায় যা ইমাম বুখারী (রাঃ) এর তাঁর সহীহ গ্রন্থে এনেছেন। নবী (সাঃ) বলেন, ‘তুমি সর্বপ্রথম তাদেরকে দাওয়াত দিবে যে, তারা যেন আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করে’।
৪ হাদীসে বর্ণিত ثم ادعهم إلى إسلام অর্থ- (তারপর তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দাও।) এর উদ্দেশ্য হল, ইসলামের দাওয়াত হচ্ছে তাওহীদের দাওয়াত। কারণ, ইসলামে সবচেয় বড় স্তম্ভ হল, এ মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এখানে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে দেন যে, তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার সাথে সাথে তাদের উপর আল্লাহর দিকে অধিকার রয়েছে তা জানিয়ে দেওয়া। চায় সে অধিকার তাওহীদ সম্পর্কিত হোক বা ফরয ও ওয়াজিব সম্পর্কিত বা হারাম থেকে সতর্ক থাকা সম্পর্কিত। এ জন্য যখন কোন ব্যক্তি কাউকে ইসলামে দাওয়াত দিবে সে যেন প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দেয় এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এর অর্থ ও মর্ম বর্ণনা করে দেয়। তারপর তাকে হারাম ও ফরয ও ওয়াজিব সম্পর্কে অবহিত করে, কেননা মৌলিক বিষয়ই প্রথম অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ও অপরিহার্য হয়ে থাকে।
০১। রাসূল (সাঃ) এর অনুসরণকারীর নীতি ও পথ হচ্ছে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা।
০২। ইখলাসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। কেননা অনেক লোক হকের পথে মানুষকে আহ্বান জানালেও মূলত সে তার নিজের নফ্স বা স্বার্থের দিকেই আহ্বান জানায়।
০৩। তাওহীদের দাওয়াতের জন্য অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন দূরদর্শিতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা একান্ত অপরিহার্য।
০৪। উত্তম তাওহীদের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআ’লা প্রতি সব ধরণের দোষ-ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা আরোপ করা থেকে পবিত্র থাকা।
০৫। আল্লাহর তাআ’লার প্রতি গাল-মন্দ আরোপ করা নিকৃষ্ট এবং জঘন্য শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
০৬। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতের মধ্যে রয়েছে, মুসলমানকে মুশরিকদের প্রভাব হতে দূরে রাখা। শির্ক না করা সত্ত্বেও কোন মুসলমান যেন মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না পরে।
০৭। [অমুসলমানকে ইসলামের প্রতি আহ্বানের] প্রথম ওয়াজিব বা অপরিহার্য কাজই হবে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ব।
০৮। সব কিছুর আগে এমনকি সালাতেরও আগে তাওহীদ দিয়ে দাওয়াত শুরু করতে হবে।
০৯। আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের অর্থ হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য প্রদান করা। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই- এ ঘোষণা দেয়া।
১০। একজন মানুষ আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সে তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে কিংবা তাওহীদের জ্ঞান থাকলেও তা দ্বারা আমল নাও করতে পারে।
১১। পর্যায়ক্রমিক ভাবে শিক্ষা দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ।
১২। বিষয়ের গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষাদান শুরু করা, তারপর গুরুত্বের পর্যায় অনুসারে শিক্ষাদানে অগ্রাধিকার প্রদান।
১৩। যাকাত প্রদানের খাত সম্পর্কিত জ্ঞান।
১৪। শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর মনে উদ্ভূত সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উন্মোচন করা বা নিরসন করা।
১৫। যাকাত আদায়ের সময় বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
১৬। মজলুমের [অত্যাচারিত] বদ দুআ’ থেকে বেঁচে থাকা।
১৭। মজলুমের ফিরিয়াদ এবং আল্লাহ তাআ’লার মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকার সংবাদ।
১৮। সাইয়ি্যদূল মুরসালীন মুহাম্মদ (সাঃ) এর বড় বড় বজুর্গানে দ্বীনের উপর যে সব দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা যন্ত্রণা, সংকট এবং কঠিন বিপদাপদ আপতিত হয়েছে, তা তাওহীদেরই প্রমাণ পেশ করে।
১৯। ‘আমি আগামীকাল এমন একজনের হাতে পতাকা প্রদান করব যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’ রাসূল (সাঃ) এর এ উক্তি নবুয়তের একটি নিদর্শন।
২০। আলী (রাঃ) এর চোখে থুথু প্রদানে চোখ আরোগ্য হয়ে যাওয়াও নবুয়তের একটি নিদর্শন।
২১। আলী (রাঃ) এর মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ।
২২। আলী (রাঃ)- এর হাতে পতাকা তুলে দেয়ার পূর্বরাতে পতাকা পাওয়ার ব্যাপারে অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার মধ্যে রাত্রি যাপন এবং বিজয়ের সুসংবাদে আশ্বস্ত থাকার মধ্যে তাদের মর্যাদা নিহিত আছে।
২৩। বিনা প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকা তথা নেতৃত্বদানের সম্মান লাভে ধন্য হওয়া আর চেষ্টা করেও [অর্থাৎ বিজয়ের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও] তা লাভে ব্যর্থ হওয়া, উভয় অবস্থায়ই তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা।
২৪। ‘বীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাও’ রাসূল (সাঃ) এর এ উক্তির মধ্যে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দানের ইঙ্গিত রয়েছে।
২৫। যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা।
২৬। ইতিপূর্বে যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদেরকেও যুদ্ধের আগে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।
২৭। أخبر هم بما يجب عليهم রাসূল (সাঃ) এর বাণী [তাদের উপর আল্লাহ তআ’লার যে সব হক রয়েছে সে সম্পর্কে তাদের যা করণীয় তা জানিয়ে দাও।] হিকমাত ও কৌশলের সাথে দাওয়াত পেশ করার ইঙ্গিত বহন করে।
২৮। দীন ইসলামে আল্লাহর হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।
২৯। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিও হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়ার তার সওয়াব।
৩০। ফতোয়ার প্রদান প্রসঙ্গে শপথ করে বলা। [এতে ফতোয়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়।]
أُولَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ الۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧ ٱلۡإِسۡرَاءِ
“এ সব লোকেরা যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় অসীলার অনুসন্ধান করে (আর ভাবে) কোনটি সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী”। (অনুবাদ সাইফুদ্দিন বেলাল মাদনী)
“তারা যাদেরকে আহবান করে তাদের মধ্যে যারা নিকটতর তারাইতো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, কে কত নিকটতর হতে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়াই তোমার রবের শাস্তি ভয়াবহ”। (অনুবাদ মুজিবর রহমান) ২ [সূরা বনী ইসরাইল ৫৭] আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেনঃ
وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦٓ إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي … ٢٧ ٱلزُّخۡرُفِ
“সে সময়ের কথা স্মরণ কর যখন ইবরাহীম তার পিতা ও কওমের লোকদেরকে বলেছিলেন, তোমরা যার ইবাদত করো তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আর আমার সম্পর্ক হচ্ছে কেবল তাঁরই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।” ৩ [সূরা যুকরুফ- ২৬] আল্লাহ তাআ’লা অন্য আয়াতে আরও ঘোষণা করেনঃ
ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗاوَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّاهُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٣١ ٱلتَّوۡبَةِ
“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও দরবেশ লোকদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে।” ৪ [সূরা তাওবাহ্- ৩১] আল্লাহর বাণীঃ
وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِنۡ دُونِ ٱللَّهِ أَنۡدَادًا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗالِّلَّهِۗ وَلَوۡيَرَي ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡتَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥ (ٱلۡبَقَرَةِ)
অর্থ- “মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাকে এমন ভাবে ভালবাসে যেমনি ভাবে একমাত্র আল্লাহকেই ভালবাসা উচিত।” ৫ [সূরা বাকারা- ১৬৫] সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
((مَنْ قَالَ لَا إله إِللَّهُ، وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُوْنِ اللَّهِ، حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ، وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ عَزَّوَجَلَّ)) (صحيح مسلم، الإيمان، باب الأمر بقتال الناس حتى يقولوا لاإله إِلا اللَّه …، ح: ۲۳)
“যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ [আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই] বলবে, আর আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয় তাকেই অস্বীকার করবে ৬ তার জান ও মাল হারাম [অর্থাৎ মাসলামানদের কাছে সম্পূর্ণ নিরাপদ]। [গোপন তৎপরতা ও অন্তরের কুটিলতা বা মুনাফিকির জন্য তার শাস্তি আল্লাহার উপর ন্যস্ত। ৭ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩] পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাওহীদ এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৮
১ সাক্ষ্য বাণীতে কয়েকটি বিষয় রয়েছে, (১) সাক্ষ্য বাণী মুখে উচ্চারণ করা। (২) যা উচ্চারণ করেছে এবং যেটি সাক্ষ্য দিয়েছে তা বিশ্বাস করা। এত থাকতে হবে জ্ঞান ও দৃঢ় বিশ্বাস। (৩) খবর দেয়া যা সাক্ষ্য বাণী সম্পর্কে অন্যকে অবহিত করা। সাক্ষ্য বাণী মুখে উচ্চারণ করা অপরিহার্য। আর সাক্ষ্য দেয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তা মুখে উচ্চারণ করে অন্যকে অবহিত না করে। সুতরাং اشهد (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি) এর অর্থ দাঁড়াবে, ‘আমি বিশ্বাস রাখি’, আমি মৌখিক স্বীকৃতি দিচ্ছি (মুখে বলি) এবং অন্যকে অবহিত করি। আর এ তিন অর্থই এর মধ্যে এক সাথে হওয়া জরুরী। لا إله إلا الله এর لا হল, نفى جنس যার ফলে এর অর্থ হল, আল্লাহ ব্যতীত কোন ব্যক্তি বা কোন কিছুই ইবাদতের উপযুক্ত নয়। نفى এর পর (হরফে ইস্তিসনা) حصر এর ফয়দা দেয় অর্থাৎ প্রকৃত মা’বূদ একমাত্র আল্লাহই তিনি ব্যতীত কোন প্রকৃত মা’বূদ নেই। إله শব্দটির আর্থ হল মা’বূদ। লায়ে নাফী জিনসের উক্ত খবর موجود নয়, কেননা আল্লাহর সাথে যে সব উপাস্যকের ইবাদত করা হয় তারাও মওজুদ। সুতরাং এক্ষেত্রে উহ্য খবর হল بحق বা حق অতএব বাক্যটির অর্থ হবে لا إله بحق অর্থাৎ প্রকৃত কোন মা’বূদ-উপাস্য নেই। কেননা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যা কিছুরই ইবাদত করা হয় তারাও তো মিথ্যা মা’বূদ-উপাস্য যদিও তাদের (এই মিথ্যা মা‘বূদের) ইবাদত করা ভ্রান্ত, বাতিল, যুলুম ও সীমা লঙ্ঘন। আর এ জন্য আরবী ভাষী لا إله الا الله শুনে এ অর্থই বুঝবে।
২ এ আয়াত يدعون এর অর্থ হল يعبدون ‘ওয়াসীলঅহ’ অর্থ ইচ্ছা ও প্রয়োজন। অর্থাৎ তারা নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহ অভিমুখী হয়। কেননা আল্লাহ তাআ’লাই এর জন্য নির্ধারিত, অতএব তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যমুখী হয় না বরং তাদের প্রবণতা আল্লাহর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ আয়াতে আল্লাহ إلى ربهم বলে রুবূবিয়্যাতের বর্ণনা দেন, কেননা দুআ’ কবুল ও সওয়াব দেয়াই হল রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এ আয়াতে তাওহীদের তাফসীর প্রস্ফুটিত হয়েছে, আর তা হল, সব ধরণের প্রয়োজন একমাত্র আল্লাহরই নিকট পুরা হতে পারে। وير جون رحمته ويخافون عذابه অর্থাৎ ‘তারা তাঁর রহমাতের আশাধারী এবং তাঁর আযাব থেকে ভয়কারী’ আর এ হল আল্লাহর বান্দদের বিশেষ অবস্থা যে তারা ইবাদতের মধ্যে মুহাব্বত, ভয় ও আকাঙ্ক্ষাকে একত্রিত করে; আর এটিই তো হল তাওহীদের তাফসির।
৩ এ আয়াতে রয়েছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক। এ দু‘টি না হলে তাওহীদের মর্ম পূর্ণ হবে না। এটি ব্যতীত কারো ইসলামও সঠিক হবে না।
৪ (‘রুবূবিয়্যাহ’ অর্থ আল্লাহর কার্যাবলী যেমন- আল্লাহ স্রষ্টা, লালন-পালনকারী, রিযিক দাতা, বিধান দাতা, হুকুম দাতা ইত্যাদি। তাই আল্লাহ সৃষ্টি কারি, লালন-পালনকারী, রিযিক দাতা, হুকুম আহাকাম বা বিধান দাতা সহ তার সকল কার্যাবলীর কর্তা। তাঁর হুকুম আহকাম তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পালন করা তাঁর নিকট প্রয়োজন পুড়ন, অভাব পুড়ন, বিপদাপদ, রোগ থেকে পরিত্রাণ সহ যতপ্রকার প্রয়োজন তাঁরই নিকট চাওয়া হচ্ছে ইবাদত। তাই যে রবের যোগ্যতা রাখে, কেবল তিনিই উপাস্য বা ইবাদতের যোগ্য। এখানে আল্লাহ তাআ’লা, বলছেন- তারা অর্থাৎ আহলে কিবাতরা [ইহুদী ও খ্রীষ্টান] আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে অর্থাৎ তাদেরকে হারাম হালাল স্থিরকারী তথা বিধান দাতা হিসেবে মেনে নিয়েছে অথচ এক মাত্র আল্লাহরই হুকুম আহকাম মান্য করা ছিল তাদের কর্তব্য আর এটাই হচ্ছে তাওহীদের মূল বিষয়।)
৫ আয়াতের তাৎপর্য হল, তারা ঐ সকল (মিথ্যা) প্রভুর ভালবাসাকে আল্লাহর ভালবাসার সাথে একীভূত করে ফেলেছে। ভলবাসায় একীভূত করে ফেলা- এটি হচ্ছে শির্ক। আর এটা তাদের জাহান্নামী করেছে। যেমন- আল্লাহ তাআ’লা জাহান্নামীদের সংবাদ দিয়ে সূরা শূরা ৯৭ ও ৯৮ নং আয়াতে বলেন- تَاللهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ * إذْ نُسَوِّيكُم بِرّبِّ الْعَالَمِينَ অর্থ- “আল্লাহর শপথ! আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিলাম। যখন আমরা তোমাদেরকে জগৎ সমূহের প্রতিপালকের সমকক্ষ মনে করতাম।” ভালবাসাও এক প্রকার ইবাদত। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসাকে একক সাব্যস্ত করল না, সে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক বানিয়ে নিল আর এটিই হল তাওহীদ বা لا إله إلا এর অর্থ।
৬ শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্র স্বীকৃতি দিলেই যথেষ্ট হবে না, বরং আল্লাহ ছাড়া সকল মিথ্যা উপাস্যকে অস্বীকার করতে হবে এবং তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭ যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং আল্লাহ ছাড়া সকল উপাস্যকে অস্বীকার করবে সেই মুসলমান। তিনটি কারণ ব্যতীত কোন মুসলমানের প্রাণ সম্পদ গ্রহণ করা হালাল হবে না।
৮ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি তাওহীদের ব্যাখ্যা। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ব্যাখ্যা। তাওহীদ পরিপন্থী বিষয়ের বিবরণ। ছোট, বড় ও গুপ্ত শিরকের বিবরণ এক কথায় তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কিত সকল বিষয়ে বিশদ বিবরণ।
এ অধ্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, তাওহীদ এবং এর সাক্ষ্য বাণীর ব্যাখ্যা। উভয়ের মাঝে কয়েকটি স্পষ্ট বিষয় রয়েছে। যেমনঃ
০১। সূরা ইসারার আয়াত, এ আয়াতে সে সব মুশরিকদের সমুচিত জওয়াব দেয়া হয়েছে যারা বুজুর্গ ও নেক বান্দাদেরকে আল্লাকে ডাকার মত ডাকে। আর এটা যে ‘শিরকে আকবার’ এ কথার বর্ণনাও এখানে রয়েছে।
০২। সূরা তাওবার আয়াত। এতে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম ও দরবেশ ব্যক্তিদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। আরো বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়নি। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অন্যায় ও পাপ কাজে আলেম ও আবিদদের আনুগত্য করা যাবে না। তাদের কাছে দু‘আও করা যাবে না।
০৩। কাফিরদের লক্ষ্য করে ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর কথা দ্বারা তাঁর রবকে যাবতীয় মা‘বুদ থেকে আলাদা করেছেন। আল্লাহ তাআ’লা এখানে এটাই বর্ণনা করেছেন যে [বাতিল মা’বুদ থেকে] পবিত্র থাকা আর প্রকৃত মাবুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ব্যাখ্যা। তাই আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেছেন- وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ অর্থ- “আর ইবরাহীম এ কথাটি পরবর্তীতে তার সন্তানের মধ্যে রেখে গেলো, যেন তারা তার দিকে ফিরে আসে” [সূরা যুখরুফ- ২৮]
০৪। সূরা বাকারার কাফিরদের বিষয় সম্পর্কিত আয়াত। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেছেন- وَمَا هُمْ بِخََارِجِينَ مِنَ النَّار (البقرة : ۱۲۷) অর্থ- “তারা কখনো জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।” এখানে আল্লাহ তাআ’লা উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকরা তাদের শরিকদেরকে [যাদেরকে তারা আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার মনে করে] ভালবাসে যেমন তারা ভালবাসে আল্লাহকে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা আল্লাহকে ভালোবাসে, কিন্তু এ ভালবাসা তাদেরকে ইসলামে দাখিল করতে পারেনি। তাহলে আল্লাহর শরিককে যে ব্যক্তি আল্লাহর চেয়েও বেশি ভালোবাসে সে কীভাবে ইসলামকে গ্রহণ করবে? আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র শরিককেই ভালোবাস। আল্লাহর প্রতি তার কোন ভালবাসা নেই তার অবস্থাই বা কি হবে?
০৫। রাসূল (সাঃ) এর বাণী, “যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয় তাকেই অস্বীকার করবে, তার ধন-সম্পদ ও রক্ত পবিত্র। [অর্থাৎ জান, মাল, মুসলমানের কাছে নিরাপদ] এ বাণী হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা। কারণ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ শুধুমাত্র মৌখিক উচ্চারণ, শব্দসহ এর অর্থ জানা, এর স্বীকৃতি প্রদান, এমন কি শুধমাত্র লা-শারীক আল্লাহকে ডাকলেই জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত কালেমা লা=ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহর ইবাদত তথা মিথ্যা মা’বুদগুলোকে অস্বীকার করার বিষয়টি সংযুক্ত হবে না। এতে যদি কোন প্রকার সন্দেহ হয়, সংশয় কিংবা দ্বিধা সংকোচ পরিলক্ষিত হয় তাহলে জান-মাল ও নিরাপত্তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অতএব এটাই হচ্ছে সর্ব শ্রেষ্ঠ বিষয়, সুস্পষ্ট বর্ণনা ও অকাট্য দলিল।
قُلۡ أَفَرَءَيۡتُم مَّا تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ إِنۡ أَرَادَنِيَ ٱللَّهُ بِضُرٍّ هَلۡ هُنَّ كَٰشِفَٰتُ ضُرِّهِۦٓ أَوۡ أَرَادَنِي بِرَحۡمَةٍ هَلۡ هُنَّ مُمۡسِكَٰتُ رَحۡمَتِهِۦۚ قُلۡ حَسۡبِيَ ٱللَّهُۖ عَلَيۡهِ يَتَوَكَّلُ ٱلۡمُتَوَكِّلُونَ ٣٨ ٱلزُّمَرِ
“(হে রাসূল!) আপনি বলেদিন, তোমরা কি মনে কর, আল্লাহ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে চান তাহলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাক,১ তারা কি তাঁর [নির্ধারিত] ক্ষতি হতে রক্ষা করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে, তারা কি তাঁর অনুগ্রহ ঠেকাতে পারবে” ২ [সূরা যুমার- ৩৮] সাহাবী ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ
((أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَجُلًا فِي يَدِهِ حَلْقَةٌ مِّنْ صُفْرٍ فَقَالَ: مَا هَٰذِهِ؟ قَالَ: مِنَ الْوَاهِنَةِ، فَقَالَ: انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لَاتَزِيدُكَ إِلَّا وَهْنًا، فَإِنَّكَ لَوْ مُتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَدًا)) (مسند أحمد: ۵۴۴/۴ وسنن ابن ماجه، الطب، باب تعليق التمائم، ح:۳۵۳۱)
অর্থ- “মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তির হাতে একটি পিতলের বালা দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, ‘এটা কি?’ লোকটি বলল, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, ‘এটা খুলে ফেলো’ কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবে না।” ৩ [আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৪৫; ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩১; তবে হাদীসটি যঈফ সনদে বর্ণিত। শায়খ আলবানী প্রমুখ এ হাদীটিকে যঈফ প্রমাণ করেছেন। দেখুন, সিলসিলাতুল আহাদীস আয্যঈফাহ, হা/১০২৯]
[ফুট নোটঃ এ হাদীসটির সনদ যঈফ হলেও অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণীত যে, তামীমা বা তাবিয কবজ, সূতা, বালা, তাগা ইত্যাদি রোগ বালাই ও বিভিন্ন কারণে শরীরে বা অন্য কিছুতে ঝুলান বা লাগান শিরক এবং গুরতর পাপ কাজ।]
উকাবা বিন আমের (রাঃ) থেকে একটি ‘মারফু’ হাদীস বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাবীয ঝুলান সম্পর্কে বলেছেনঃ
((مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيْمَةً فَلَا أَتَمَّ اللَّهُ لَهُ، وَمَنْ تَعَلَّقَ وَدَعَةً فَلَا وَدَعَ اللَّهُ لَهُ)) (مسند أحمد:۱۵۴/۴)
“যে তাবিয ঝুলাল বা লাগাল আল্লাহ তার সে উদ্দেশ্য পূরণ করবেন না। আর যে ঝিনুক, সামুক/অনুরূপ কিছু ঝুলাল আল্লাহ তাকে স্বস্তিতে রাখবেন না”। ৪ [আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৪৫] অনুরূপ হাদীস ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩১ কে আলবানী যঈফ বলেছেন তবে হাদীসের বর্ণনা অন্যান্য সহীহ হাদীসের বর্ণনা মতে যেমন- “যে তাবীয ঝুলাল সে শিরক করল” তার অনুকূল হাওয়াতে হাদীসটির বর্ণনা সহীহ থেকে বাদ দেয়া যায় না।]
((مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ)) (مسند أحمد:۱۵۶/۴)
অর্থ- “যে ব্যক্তি তাবিয ঝুলাল সে শির্ক করল।” [মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৬ হাদীসটির মান সহীহ।] ইবনে আবি হাতেম হুযাইফা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
((أَنَّهُ رَأَىٰ رَجُلًا فِي يَدِهِ خَيْطٌ مِّنَ الْحُمَّى فَقَطَعَهُ)) (ذكره ابن كثير في التفسير: ۳۴۶/۴)
অর্থ- “জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সূতা বা তাগা পরিহিত অবস্থায় তিনি একজন লোককে দেখতে পেয়ে তিনি সে সূতা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এ আয়তটি তিলাওয়াত করলেন” হাদীসটির মান সহীহ।
وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُمۡ بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ يُوسُف
অর্থ- “অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সত্ত্বেও মুশরিক।” ৫ [সূরা ইউসুফ, ১০৬, তাফসির ইবনু কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪২] হাদীসটির মান সহীহ।
* এ অধ্যায়ে তাওহীদের বর্ণনা শুরু হচ্ছে তার পরিপন্থী শিরকের বর্ণনার মাধ্যমে। সর্বজনবিদিত যে, কোন বস্তু সম্পর্কে জানার দু’টি দিক রয়েছেঃ তার বাস্তবতা কে উপলব্ধি ও তার বিপরীত বিষয় কে জানা। ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব এখানে তাওহীদের বিপরীত বিষয় অর্থাৎ শিরকে আকবারের বর্ণনা করেন। আর তাওহীদের পরিপন্থী যা অর্থাৎ মহা শিরক- শিরকে আকবার তাওহীদকে স্বমূলে বিনাশ করে দেয় এবং যে এ মহা শিরকে পতিত হয় সে মিল্লাতে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। আর দ্বিতীয়তঃ কতিপয় শিরক এমন রয়েছে যা মূল তাওহীদের পরিপন্থী। কেননা পরিপূর্ণ তাওহীদ হল, সব ধরণের শির্ক থেকে মুক্ত থাকা। শায়খ- রহিমাহুল্লাহ শিরকের বিশদ বর্ণনায় কিতিপয় এমন ছোট শিরকের মাধ্যমে শুরু করেন যাতে মানুষ সাধারণত বেশি বেশি পতিত হয় এবং তিনি নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ে ধাবিত হওয়ার ভিত্তিতে ছোট শির্ক মহা শিরকের পূর্বে বর্ণনা করেন।
বিশেষ আকিদা বিশ্বাস নিয়ে যা কিছুই ঝুলান হবে অথবা পরা হবে সেটিই এর (বালা সূতা প্রভৃতি) অন্তর্ভুক্ত হবে, চাই সেটি বাড়িতে ব্যবহার করা হোক অথবা গাড়িতে অথবা ছোটদের শরীরে লাগান হোক এসব কিছু শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আরবদের বিশ্বাস ছিল এগুলিতে উপকার হয়। হয়ত বা বালা-মুসীবতে পতিত হওয়ার পর তা দূরকরার ক্ষেত্রে বা তাতে পতিত হওয়ার পূর্বেই তা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে। আর এ বিশ্বাস হল মারাত্মক। কেননা এতে বিশ্বাস করা হয় যে, এ নগণ্য বস্তু নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআ’লা নির্ধারিত তাকদীরকেও প্রতিহত করে, এ ধরণের বিশ্বাস কি ভাবে ছোট শির্ক হতে পারে? বরং তা বড় শির্ক। কেননা এ বিশ্বাসীর অন্তর সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং সেগুলিকে বিপদ-আপদ উদ্ধার ও তা প্রতিহত করার কারণ বলে মনে করে। এ ক্ষেত্রে এর সূত্র হল, শরীয়াত সম্মত কারণ ব্যতীত ক্রিয়াকারী কোন কারণই সাব্যস্ত করা জায়েয নয়। অথবা এমন কোন বাস্তব প্রয়োগকৃত স্পষ্ট কারণ হতে হবে যার মধ্যে কোনরূপ অস্পষ্টতা ও গোপনীয়তা নেই। যেমন- ডাক্তারী ঔষধ এমন কোন মাধ্যম যার উপকার বা ক্রিয়া প্রকাশ্যঃ যেমন- আগুন দ্বারা তাপ গ্রহণ, পানি দ্বারা ঠাণ্ডা বা অনুরূপ কিছু। এসব মাধ্যম প্রকাশ্য যার প্রভাবই স্পষ্ট। কখনো কখনো ব্যক্তির নিয়তের ভিত্তিতে সব ধরণের ছোট শির্ক মহা শিরকে পরিণত হতে পারে। যেমন- বালা, সূতা, পরার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি যদি সেটিকে মাধ্যম মনে না করে সরাসরি তাকেই ক্রিয়াকারী বিশ্বাস করে তবে তা মহা শিরকে পরিণত হয়ে গেল। অতএব এ অধ্যায় অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত।
১ অর্থাৎ তোমরা স্বীকার করছ যে, যিনি আকশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনিই আল্লাহ্ এরপর আবার অন্য কিছুর ইবাদতে লিপ্ত হচ্ছ? কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআ’লা এরূপ নীতি ব্যক্ত করেছেন যে, মুশরিকরা যে তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ স্বীকৃতি দেয় কুরআন তাদের ঐ স্বীকৃতিকেই তাদের বিরুদ্ধে পেশ করবে ইবাদতের তাওহীদকে সাব্যস্ত করে। (অর্থাৎ তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ তাওহীদে উলুহিয়্যাহকে বাধ্যতামূলক করে। তাই প্রত্যেক মুশরিকের বিরুদ্ধে তাওহীদে উলুহিয়্যাহ বাস্তবায়ন না করার জন্য অভিযোগ আনা হবে।) تدعون শব্দটিতে দু‘আ দুই অর্থে ব্যবহৃত, প্রার্থনা মূলক ও ইবাদত মূলক। মুশরিকদের দুআ’তে এ দু‘প্রকারই বিদ্যমান। আল্লাহ ব্যতীত যাকে ডাকা হয় তারা বিভিন্ন ধরণের। তাদের মধ্যে কেউ নবী, রাসূল ও সৎ লোকদেরকে আহবান করে, আবার কেউবা আল্লাহর ফিরিস্তাকে, আবার কেউ তারকামণ্ডলীর দিকে ধাবিত হয়, কেউবা গাছ বা পাথরের প্রতি এবং অন্যরা মূর্তির প্রতি ধাবিত হয়।
২ উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা সব ধরণের বাতিল মা’বূদদের ক্ষতি ও উপকার সাধনের ক্ষমতাকে বাতিল সাব্যস্ত করেন। অতএব উক্ত ভ্রান্ত মা’বুদগুলি সম্পর্কে মুশরিকদের বিশ্বাস যে আল্লাহর নিকট তাদের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে, যার ফলে তারা তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে, এ ভ্রান্ত দাবিকে এই আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা বাতিল ও ভিত্তিহীন ঘোষণা করেন। সালাফে সালেহীন ছোট শিরকের বিলোপ সাধনের জন্য বড় শিরকের ক্ষেত্র বর্ণিত আয়াত পেশ করেন। কারণ উভয় শির্কই হচ্ছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। বড় শির্ক এর সাথে সম্পর্ক ছেদ করা হচ্ছে, এ বিশ্বাস করা যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো এ ক্ষমতা নেই যে, সে কারো- কোন ক্ষতি করতে পারে বা কোন উপকার সাধন করতে পারে। অনুরূপ আল্লাহ কারো ক্ষতি করতে চাইলে বা উপকার করতে চাইলে এমন কেউ নাই যে তা প্রতিরোধ করতে পারে।’ মুশরিকরা এ বিশ্বাসের বিপরীত বিশ্বাস পোষণ করে, তাই তারা বালা ও সূতা পরিধান করে এই জন্য যে এটা তার উপকার করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ এ সব জিনিসের মধ্যে এমন কোন উপকার করার ক্ষমতা দেননি।
৩ হাদীসে বর্ণিত ماهذا শব্দটি রাসূল (সা..) এর দৃঢ় প্রতিবাদ মূলক বাণী, الوا هنة এক ধরণের রোগ যা শরীরকে দূর্বল করে দেয়। অতঃপর নবী (সা..) বলেন, সেটিকে খুলে ফেল। এ ছিল তাঁর নির্দেশ, যদি এমন ব্যক্তি হয় যে তাকে নির্দেশ দিলে সে মেনে নিবে তবে তাকে মুখ দ্বারা নির্দেশ দেয়াই যথেষ্ট, হাত দ্বারা বারণ করার প্রয়োজন নেই। فإنك لا تزيدك إلا وهنا অর্থ- ‘এ তোমার অসুস্থতা বৃদ্ধিই করবে।’ অর্থাৎ যদি তোমার বিশ্বাস অনুযায়ী তার কোন প্রভাব থাকে তবে তা শুধু তোমার শরীরেই ক্ষতি সাধান করবে না বরং তার সাথে অন্তর-আত্মারও ক্ষতি সাধন করবে যার ফলে তোমার অন্তর ও আত্মা দুর্বল ও ব্যধিগ্রস্তই হয়ে পড়বে। এ হল প্রত্যেক মুশরিকের অবস্থা যে, (না বুঝার কারণে) ছোট ক্ষতি থেকে বড় ক্ষতিতে নিমজ্জিত হয়। তাঁর বাণী- فإنك لرمت وهي عليك ما أفلحت إبدا অর্থ- “যদি তোমার এ অবস্থায় মৃত্যু হয় তবে কোনক্রমেই মুক্তি-পরিত্রাণ পাবে না।” যে পরিত্রাণকে অস্বীকার করা হয়েছে তা দুই প্রকারের হতে পারে, (ক) পূর্ণ পরিত্রাণ। আর তা হচ্ছে জান্নাতে প্রবেশ এবং জাহান্নাম আগুন থেকে মুক্তি। আর যারা যারা মহা শির্ক করবে অর্থাৎ এক্ষেত্রে এ বিশ্বাস করবে যে, পিতলের বালা সূতা যা ঝুলান হয় তা নিজে নিজেই উপকার সাধন করতে পারে তারা পরিত্রাণ থেকে বঞ্চিত হবে। (খ) আংশিক পরিত্রাণ, যখন মানুষ ছোট শিরকে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ ঐ বস্তুকে মুক্তির কারণ হিসেবে গ্রহণ করা আল্লাহ যা কারণ সাব্যস্ত করেননি। এ জন্য তা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
৪ আরবী ভাষা থেকে ‘তামীমাহ’ শব্দ এসেছে। চোখ লাগা অথবা ক্ষতি, হিংসা প্রভৃতি থেকে বাঁচার জন্য যা কিছু বুকে লটকান বা ঝুলান হয় তাই তামীমাহ বা আমরা বলি তাবীয। তমীমা এর নামকরণ- তামীমা বলা হয় এ জন্য যে, এর দ্বারা বিশ্বাস করা হয় যে, তা কৃতকার্য পূর্ণ করবে। সুতরাং নবী (সা..) বদদুআ’ করেন যেন তার দ্বারা কিছু পূর্ণ না হয়। ‘ওয়াদআ’হ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে এক প্রকার ঝিনুক যা লোকেরা বুকে অথবা হাতে ঝুলায় অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য। এমন কর্মকারীদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা..) বদদুআ’ করেন, যেন আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে আরাম, শান্তি ও স্থিরতায় থাকতে না দেন।, কেননা সে আল্লাহর সাথে কোন শরিক করেছে।
৫ হাদীসে বর্ণিত من الحمى অর্থাৎ- সে ব্যক্তি জ্বর দূর করার জন্য অথবা তা প্রতিহত করার জন্য সূতা ঝুলিয়েছিল। অতঃপর তিনি তা কেটে দেন। এই কেটে দাওয়া প্রমাণ করে যে- এ সব ঝুলান বা পরিধান করা বড় অন্যায়। অতএব তা বাধা দেয়া ও কেটে ফেলা জরুরী। এতে প্রমাণিত হয় যে, শুধু তাওহীদে রুবূবিয়্যাহর স্বীকৃতি দিলেই মুক্তি পাওয়া যাবে না বরং ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রেও তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ আয়াতটি হল মহা শিরকের দলীল। লেখক বলেন- সাহবা (রা..) গণ মহা শিরকের ব্যাপারে অবতীর্ণ আয়াত সমূহের দ্বারা ছোট শিরকেরও উদ্দেশ্য করে থাকেন। [আলবানী (রহঃ) উপরের দুইটি হাদীস এর সনদ যঈফ বললেও পবিত্র কুরআনের আয়াত ও নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা এটা পরিষ্কার বুঝাযায় যে রোগ বা বালা-মুছিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার বা দুর্বলতা দূর করার জন্য কিছু ঝুলান বা পরিধান করা যেমন- বালা, রিং, সূতা-তাগা ইত্যাদি পরিধান করা শির্ক]
০১। রিং (বালা) ও সূতা ইত্যাদি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পরিধান করার ব্যাপারে অধিক কঠোরতা।
০২। স্বয়ং সাহাবীও যদি এসব জিনিস পরিহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তাহলে তিনিও সফলকাম হতে পারবেন না। এতে সাহাবায়ে কিরামের এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ছোট শির্ক কবিরা গুনাহর চেয়েও মারাত্মক।
০৩। এক্ষেত্রে অজ্ঞতার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
০৪। ‘ইহা তোমার দুর্বলতা ছড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না।’- এ কথার দ্বারা এটাই প্রমাণীত হয় যে, রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রিং (বালা) বা সূতা পরিধান করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই বরং অকল্যাণ আছে।
০৫। যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজ করে তার কাজকে কঠোর ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
০৬। এ কথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি (রোগ নিরাময়ের জন্য [যে কোন ধরণের রিং সূতা] শরীরে লটকাবে তার কুফল তার উপরই বর্তাবে।
০৭। এ কথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে তাবিয ব্যবহার করল সে মূলতঃ শির্ক করল।
০৮। জ্বর নিরাময়ের জন্য সূতা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
০৯। সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) কর্তৃক কুরআনের আয়াত তিলওয়াত করা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম শিরকে আসগরের দলিল হিসেবে ঐ আয়াতকেই পেশ করেছেন যে আয়াতে শিরকে আকবার বা বড় শির্ক এর কথা রয়েছে। যেমনটি ইবনে আব্বাস (রাঃ) বাকারার আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
১০। নজর বা চোখ লাগার জন্য শামুক, কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি লটকানো বা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
১১। যে ব্যক্তি তাবিয ব্যবহার করে তার উপর বদ দুআ’ করা হয়েছে, ‘আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। আর যে ব্যক্তি শামুক, কড়ি বা শঙ্খ (গলায় বা হাতে) লটকায় তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।’
আবু বাসীর আনসারী (রাঃ) থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিতঃ
((أَنَّهُ كَانَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ فَأَرْسَلَ رَسُولًا أَن لَّا يَبْقَيَنَّ فِي رَقَبَةِ بَعِيرٍ قِلَادَةٌ مِّن وَةَرٍ – أَوْ قِلَادَةٌ – إِلَّا قُطِعَتْ)) (صحيح البخارى، الجهاد، باب ما قيل في الخرس ونحوه في أعناق الإبل، ح:۳۰۰۵ وصحيح مسلم، اللباس، باب كراهة قلادة الوتر في رقبة البعير، ح:۲۱۱۵)
অর্থ- “তিনি একবার রাসূল (সা..) এর সফর সঙ্গী ছিলেন। এ সফরে রাসূল (সাঃ) একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য দূত পাঠালেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কোন উটের গলায় যেন ধনুকের কোন কিছু লটকানো না থাকে অথবা এ জাতীয় রুজ্জু যেন কেটে ফেলা হয়।” ১ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১১৫] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা..) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (সা..) কে এ কথা বলতে শুনেছিঃ
((إِنَّ الرُّقَىٰ وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ)) (مسند أحمد:۳۸۱/۱ وسنن أبي داود، الطب، باب تعليق التمائم، ح:۳۸۸۳)
অর্থ- “নিশ্চয়ই ঝাড়ফূঁক, তাবীয ও পরস্পর প্রেম-ভালবাসা সৃষ্টির জন্য কোন কিছু তৈরি করা শির্ক।” ২ [মুসনাদ আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৮; সুনান আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩৮৮৩] আব্দুল্লাহ বিন উকাইম (রা..) থেকে মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছেঃ
((مَن تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ)) (مسند أحمد: ۳۱۰/۴، ۳۱۱ وجامع الترمذي، الطب، باب ما جاء في كراهية التعليق، ح:۲۰۷۲)
অর্থ- “যে ব্যক্তি কোন জিনিস (তাবিয-কবজ) লটকায় যে উক্ত জিনিসের দিকেই সমর্পিত হয় [এর কুফল তার উপরই বর্তায়]” ৩ [আহমদ, ৪/৩১০; জামি তিরমিযী, হাদীস নং ২০৭৬] تمائم (তামায়েম) বা তাবীয হচ্ছে এমন জিনিস যা চোখ লাগা বা দৃষ্টি লাগা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সন্তানদের গায়ে ঝুলান হয় ৪ । ঝুলন্ত জিনিসটি যদি কুআনের অংশ হয় তাহলে সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এর অনুমতি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অনুমতি দেননি বরং এটাকে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় বলে গণ্য করতেন। ইবনে মাসউদ (রা..) এ অভিমতের পক্ষে রয়েছেন। ৫ আর رقى বা ঝাড়-ফুঁককে عزائم নামে অভিহিত করা হয়। যে সব ঝাড়-ফূঁক শির্ক মুক্ত তা দালিলের মাধ্যমে খাস করা হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম চোখের দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষের ব্যাপারে ঝাড়-ফূঁকের অনুমতি দিয়েছেন। تولة এমন জিনিস যা কবিরাজদের বানানো। তারা দাবি করে যে, এ জিনিস [কবজ] দ্বারা স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর ভালোবাসা আর স্বামীর অন্তরে স্ত্রীর ভালোবাসার উদ্রেক হয়। সাহাবী রুআইফি (রা..) থেকে ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ
((يَا رُوَيْفِعُ! لَعَلَّ الْحَيَاةَ تَطُولُ بِكَ، فَأَخْبِرِ النَّاسَ أَنَّ مَنْ عَقَدَ لِحْيَتَهُ، أَوْ تَقَلَّدَ وَتَرًا، أَوِ اسْتَنْجَىٰ بِرَجِيعِ دَابَّةٍ أَوْ عَظْمٍ، فَإِنَّ مُحَمَّدًا بَرِىءٌ مِّنْهُ)) (مسند أحمد:۱۰۸/۴، ۱۰٩ وسنن أبي داود، الطهارة، باب ما ينهى عنه أن يستنجى به ح:۳۲)
অর্থ- “রাসূল (সা..) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে রুআইফি, তোমার হায়াত সম্ভবত দীর্ঘ হবে। তুমি লোকজনকে জানিয়ে দিও, ‘যে ব্যক্তি দাড়িতে গিরা দেবে, অথবা গলায় তাবিয কবজ ঝুলাবে অথবা পশুর মল কিংবা হাড় দ্বারা এস্তেঞ্জা করবে, মুহাম্মদ (সা..) তার জিম্মাদারী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ।” ৬ [মুসনাদে আহমাদ, ৪/১০৭, ১০৯; সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ৩৬] সাঈদ বিন জুবাইর (রা..) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
((مَنْ قَطَعَ تَمِيمَةً مِّنْ إِنْسَانِ كَانَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ)) (المصنف لابن أبي شيبة، ح:۳۵۲۴)
অর্থ- “যে ব্যক্তি কোন মানুষের তাবিয কবজ ছিড়ে ফেলবে বা কেটে ফেলবে সে ব্যক্তি একটি গোলাম আযাদ করার মত কাজ করল।” ৭ [ওয়াকী এটি বর্ণনা করেছেন; মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৫২৪] ইবরাহীম ওয়াকী বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেনঃ
((كَانُوا يَكْرَهُونَ التَّمَائِمَ كُلَّهَا مِنَ الْقُرْءَانِ وَغَيْرِ الْقُرْءَانِ)) (المصنف لابن أبي شيبة، ح:۳۵۱۸)
অর্থ- “সাহাবায়ে কিরামগণ সব সময় তাবীজ-কবজ অপছন্দ করতেন, চাই তার উৎস কুরআন হোক বা অন্য কিছু হোক।” ৮ [মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৫১৮]
* এ অধ্যায়ে ঝাড়-ফুঁকের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। ঝাড়ফুঁক হচ্ছে এমন সব দুআ’ যা পড়ে ফুঁক দেয়া হয়। কোনটি শরীরে ক্রিয়া করে আবার কোনটি রূহে ক্রিয়া করে। কোনটি জায়েয আবার কোনটি শির্ক। শির্ক-মুক্ত ঝাড়-ফুঁক জায়েয। নবী (সা..) বলেন, যে ঝাড়-ফুঁক শির্ক নেই তাতে কোন দোষ নেই। শির্ক-যুক্ত ঝাড়-ফুঁকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নিকট আশ্রয় চাওয়া হয় অথবা ফরিয়াদ করা হয়। অথবা তাতে থাকে শয়তানের নাম আথবা এ বিশ্বাস রাখা হয় যে, খোদ ঝাড়-ফুঁকই ক্রিয়া করবে, তখন এ ধরনের ঝাড়-ফুঁক নাজায়েয হবে ও তা শিরকী ঝাড়-ফুঁক এর অন্তর্ভুক্ত।
আর তামীমা অর্থাৎ যাকে আমরা তাবীয বলি তা থেকে উদ্দেশ্য হল চামড়া, পুঁতি, লিখিত কিছু শব্দাবলী যা বিভিন্ন ধরণের বস্তু যেমন- ভালুকের অথবা হরিণের মাথা, ঘোড়ার ঘাড়, কাল কাপড়, চোখের আকৃতি বা তসবীর নির্ধারিত আকৃতির কিছু ঝুলানো ইত্যাদি। এ সব তাবীযের অন্তর্ভুক্ত। মোট কথা প্রত্যেক ঐ বস্তু যার ব্যাপারে ধরণা করা হয় যে, এটি কল্যাণ ও ভাল কাজের মাধ্যেম বা কারণ এবং অনিষ্ঠের প্রতিরোধক তাই হল তামীমা বা তাবীয। আর শরীয়ত এর অনুমতি দেয়নি। কতিপয় লোক বলে, এগুলি এমনি এমনি ঝুলাই তাতে অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই বা বলে থাকে তা গাড়িতে বা বাড়িতে শোভা-সৌন্দর্য্যের জন্য ঝুলান ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু জেনে রাখা উচিত, তাবীয যদি কোন কিছু প্রতিরোধ বা দূর করার জন্য ঝুলান হয় আর বিশ্বাস করা হয় যে, তাবীয এ ক্ষেত্রে একটি মাধ্যম বা কারণ তা নিশ্চয়ই ছোট শির্ক। আর যদি তা শোভা-বর্ধন এর জন্য ঝুলান হয় তবে তা হবে হারাম, কেননা যার মাধ্যমে ছোট শির্ক হয় তার সাদৃশ্য হয়ে যায়। আর নবী (সা..) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্য ধারণ করল সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।
১ আরবের বিশ্বাস ছিল এ ধরণের হার, জীব-জন্তুকে চোখ লাগানো থেকে রক্ষা করে তাই ওটি কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২ এ হাদীসে ঝাড়-ফুঁক, তাবীয ও প্রেম-ভালবাসা সৃষ্টির জন্য কোন কিছু তৈরি শির্ক বলে গণ্য করা হয়েছে। আসলে ঝাড়-ফুঁক দুই প্রাকার ১) শিরকি/কুফরি শব্দ যোগে ঝার-ফুঁক অথবা এ ধারণ করে ঝার-ফুঁক করা এ উচ্চারিত শব্দই (তা ভাল শব্দ হলেও) তাকে প্রতিকার করবে। এ ঝাড়-ফুঁক শিরক। ২) শির্ক মুক্ত ঝাড়-ফুঁক। কেননা অন্য হাদীসে আছে, ‘শির্ক না হওয়া পর্যন্ত ঝাড়-ফুঁক কোন দোষ নেই’। এ ছাড়া মহানবী (সা..) নিজে ঝাড়-ফুঁক করেছেন এবং তাঁকেও ঝাড়-ফুঁক করা হয়েছে। অতএব দলীলে প্রমাণ করে যে, শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুঁক জায়েয। অপরদিকে সকল প্রকার তাবীয, তাগা, যাদু ও কোন কিছু ঝুলান বা লাগানো নিষিদ্ধ। التو لة শায়খ তেওয়ালার ব্যাখ্যা দেন যে, নিশ্চয়ই এটি এমন জিনিস যা তারা তৈরি করে এবং ধারণা করে থাকে যে, এটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরের ভালবাসা সৃষ্টি করে। অতএব এটি যাদুর এক প্রকার। সাধারণ লোকে একে মন ফিরান বা মন গলিয়ে দেয়া নামে অভিহিত করে। প্রকৃত পক্ষে তা তাবীয-কবজের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তা বিশেষ পন্থায় তৈরি করে যাদুকরই তাতে শির্ক মন্ত্র ফুঁকে দেয়। যার ফলে তাদের ধারণা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালবাসতে থাকে। তাই এটি এক ধরণের যাদু, আর যাদু আল্লাহর সাথে শির্ক ও কুফুরী।
৩ সকল প্রকার তাবীয নিষিদ্ধ, যে ব্যক্তি তাবীযকে হালাল করার জন্য ফাঁক ফোকর খুঁজবে সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বান্দা যদি স্বীয় অন্তর থেকে সমস্ত কিছুর ভরসাকে বের করে এক মাত্র আল্লাহর প্রতি ভরসা করে তবে তাতে আনন্দ, মুক্তি ও সাফল্য রয়েছে।
৪ দলীল দ্বারা প্রমাণ রয়েছে যে, সকল প্রকার তাবীযই নিষিদ্ধ, তাই আল্লাহর কালাম কুরআন পাকের কোন অংশকে তাবীয হিসেবে বানানও নিশিদ্ধ। তবে এটা শির্ক পর্যায়ে নয়।
৫ কল্যাণ আনার জন্য এবং অকল্যাণ দূর করার জন্য যা কিছু ঝুলান হয় তাই তাবীযের অন্তর্ভুক্ত।
৬ দাড়িতে গিরা দেয়া, গলায় তাবীয কবজ ঝুলান, পশুর মল কিংবা হাড়া দ্বারা এন্তেঞ্জা করা হারাম বা কিবরা গুণাহর কাজ।
৭ এতে তাবীয কবজ কেটে ফেলা বা ছিড়ে ফেলার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। যে তাবীয কবজ কেটে ফলবে বা ছিড়ে ফেলবে সে একটি গোলাম আজাদ করার সোয়াব পাবে।
৮ অর্থাৎ ইবনে মাসউদ (রা..) এর সঙ্গীগণ সকল প্রকার তাবীযকে অপছন্দ করতেন।
০১। ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজের ব্যাখ্যা।
০২। تولة ‘তাওলাহ’ এর ব্যাখ্যা।
০৩। কোন পার্থক্য ছাড়াই শরীয়ত সম্মত নয় এমন ঝাড়-ফুঁক, তাবীয ও তাগা এ সবই শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
০৪। সত্যবাণী তথা কুরআনের সাহায্যে চোখ লাগা বা দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্চুর বিষ নিরাময়ের জন্য ঝাড়-ফুঁক করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত নয়।
০৫। তাবীয-কবয কুরআন থেকে হলে তা শির্ক হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মত ভেদ আছে। (তবে শিরকের সাদৃশ্য হওয়ার কারণে এ সব ঝুলান হারাম।)
০৬। চোখ লাগা থেকে জীব-জন্তুকে রক্ষা করার জন্য রশি বা কিছু ঝুলান শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
০৭। যে ব্যক্তি ধনুকের রজ্জু গলায় ঝুলায় তার উপর কঠিন অভিসম্পাত।
০৮। কোন মানুষের তাবিজ-কবজ ছিড়ে ফেলা কিংবা কেটে ফেলার ফজিলত।
০৯। ইবরাহীমের কথা পূর্বোক্ত মতভেদের বিরোধী নয়। কারণ এখানে আসহাব বলতে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা..) এর সহচরবৃন্দ উদ্দেশ্য।
[Page- 1]