Dawah wa Tablig Islamic Website

Help Line = Mob no. +8801783385346 :: Email Address = shalampb@gmail.com || To see the Arabic (Saudi Print) correctly use "Mozilla Firefox" Browser.

5

Page- 5


অধ্যায়-৩১

ভয়ভীতি শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ يُخَوِّفُ أَوۡلِيَآءَهُۥ ۖ فَلَا تَخَافُوهُمۡ وَخَافُونِ كُنۡتُم مُّؤۡمِنِينَ ١٧٥ آلِ عِمۡرَانَ

অর্থঃ “এরা যে রয়েছে, এরাই হলো শয়তান, এরা নিজেদের বন্ধুদের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না। আর তোমরা যদি ঈমাদার হয়ে থাক তবে আমাকে ভয় কর।” * [সূরা আল-ইমরান ১৭৫]

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهِ ۖ ١٨ ٱلتَّوۡبَة

অর্থঃ “নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং কায়েম করেছে সালাত, আদায় করেছে যাকাত এবং আল্লাহ তা ‘আলাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না [সূরা তাওবা- ১৮]

আল্লাহ তা‘আল্লাহ অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেনঃ

وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ فَإِذَآ أُوذِىَ فِى ٱللَّهِ جَعَلَ فِتۡنَةَ ٱلنَّاسِ كَعَذَابِ ٱللَّهِ ١٠ ٱلۡعَنۡكَبُوت

অর্থঃ “কতক লোক বলে, আমরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি; কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয় তখন তারা মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মত মনে করে।” [সূরা আনকাবূত- ১০]

আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

((إِنَّ مِنْ ضَعْفِ الْيَقِينِ أَنْ تُرْضِيَ النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ، وَأَنْ تَحْمَدَهُمْ عَلَىٰ رِزْقِ اللَّهِ، وَأَنْ تَذُمَّهُمْ عَلَىٰ مَا لَمْ يُؤْتِكَ اللَّهُ، إِنَّ رِزْقَ اللَّهِ لَا يَجُرُّهُ حِرْصُ حَرِيصٍ، وَّلَا يَرُدُّهُ كَرِهٍ)) (شعب الإيمان، الخامس من شعب الإيمان، وهو باب في أن القدر…، ح:۲۰۷)

“ঈমানের দূর্বলতা হচ্ছে আল্লাহ পাককে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা, আল্লাহ পাকের রিযিক ভোগ করে মানুষের গুণাগুন করা, তোমাকে আল্লাহ যা দান করেননি তার ব্যাপারে মানুষের বদনাম করা। কোনো লোভীর লোভ আল্লাহ পাকের রিযিক টেনে আনতে পারে না। আবার কোন ঘৃণাকারীর ঘৃণা আল্লাহ পাকের রিযিক বন্ধ করতে পারে না।”

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছ, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ

((مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَاطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَىٰ عَنْهُ النَّاسَ، وَمَنِ الْتَمَسَ رَضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ)) (موارد اظمآن إلى زوائد ابن حبان، ح: ۱۵۴۱_۱۵۴۶ وجامع الترمذي، ح:۲۴۱۴ وله الفاظ أخرى)

“যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ পাককে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ পাকও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন।” (ইবনে হিব্বান)।

ব্যাখ্যাঃ

* অত্র অধ্যায় আল্লাহ তা ‘আলাকে ভয় করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত সে সম্পর্কে, যা আন্তরিক অপরিহার্য ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এবং সেটার পূর্ণতা তাওহীদের পূর্ণতা এবং অসম্পূর্ণতা তাওহীদের অসম্পূর্ণতা। আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ভয় করা তিন প্রকারের, প্রথমটি শিরক, দ্বিতীয়টি হারাম এবং তৃতীয়টি বৈধ। (এক) যে ভয় শিরকঃ এরূপ ধারণা পোষণ করা যে, অমুক ব্যক্তি, তিনি নবী হোন, অলী হোন আর জিন হোন গোপণে তার ক্ষতিসাধন করার ক্ষমতা রাখে এটা দুনিয়ার ব্যাপারে হোক কিংবা পরকালের ব্যাপারেঃ পরকালের ক্ষেত্রে শিরকী ভয় হলঃ কারো এ ধরনের ভয় করা যে, উক্ত অলীরা সম্মানিত ব্যক্তি পরকালে তার উপকার করবে, সুপারিশ করবে পরকালে তার নৈকট্য লাভ করতে পারবে, আযাব দূর করবে, তাই তাকে ভয় করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে। (দুই) নিষিদ্ধ ভয়ঃ কারো প্রতি ভয়ের কারণে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন হতে বিরত থাকা। (তিন) প্রকৃতিগত বা স্বভাবগত ভয়ঃ যেমন শত্রু থেকে ভয়, হিংস্র প্রাণী থেকে ভয়, আগুন থেকে ভয় ইত্যাদি। আল্লাহ বাণীঃ “তোমরা আমাকে ভয় কর যদি তোমরা মু’মিন হও।” ভয় করার নিদের্শ প্রদান এ কথই প্রমাণ করে যে ভয় একটি ইবাদত।

“একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করো না” অত্র আয়াতের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, ভয় একমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে এবং যারা শুধুমাত্র আল্লাহকেই ভয় করেন তিনি তাদের এখানে প্রশংসা করেছেন।

‘মানুষের চাপানো দুঃখ কষ্টের পরীক্ষাকে তারা আল্লাহর আযাবের সমতুল্য মনে করে।’ অর্থাৎ সে পরীক্ষাকে ভয় পায় এবং তার প্রতি আল্লাহর বিধান যেটা ওয়াজিব সেটা ছেড়ে দেয় অথবা মানুষের কথার ভয়ে গর্হিত কাজ করে ফেলে।

ঈমানের দূর্বলতা হচ্ছে আল্লাহ পাককে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি করা, ..। এটাই ঈমানের দূর্বলতা এবং হারাম কাজগুলি ঈমানকে দূর্বল করে ফেলে কেননা ঈমান আনুগত্যের মাধ্যমে বর্ধিত হয় এবং পাপের কারণে ঈমান হ্রাস পায় এবং অত্র আলোচনা থেকে এও প্রামাণিত হয় যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রেখে মানুষকে খুশি করা যেমন পাপ তেমনি হারাম।

প্রথমটি হলো যারা আল্লাহকেই ভয় করবে তার প্রতিদান। আর দ্বিতীয়টি যে ভয়মূলক ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওহীদপূর্ণ করবেন না তার প্রতিদান, কেননা সে মানুষকে ভয় করে পাপে পতিত হয়েছে এবং সে মানুষ থেকে ভয় করাকে হারামে লিপ্ত হওয়ার ও ফরয কাজ পরিত্যাগ করার কারণ বানিয়েছে।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা আল-ইমরানের ১৭৫ নং আয়াতের তাফসীর।

০২। সূরা তাওবার ১৮ নং আয়াতের তাফসীর

০৩। সূরা তাওবার ১০নং আয়াতের তাফসীর

০৪। ঈমান শক্তিশালী হওয়া আবার দূর্বল হওয়া সংক্রান্ত কথা।

০৫। উপরোল্লিখত তিনটি বিষয়ে ঈমানের দূর্বলতার আলামত।

০৬। ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহ পাককে ভয় করা ফরজের অন্তর্ভুক্ত।

০৭। আল্লাহকে যে ভয় করে তার জন্য সওয়াবের উল্লেখ।

০৮। অন্তর থেকে আল্লাহপাকের ভয় পরিত্যাগকারী জন্য শাস্তির উল্লেখ।


অধ্যায়-৩২

একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٣ ٱلۡمَائِدَةِ

অর্থঃ “আর আল্লাহর উপর ভরসা কর যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।” * [সূরা মায়েদা- ২৩]

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَاذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ ٢ ٱلۡأَنۡفَال

অর্থঃ “যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর।” [সূরা আনফাল- ২]

আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক আয়াতে ইরশাদ করেছেনঃ

يَٰٓۤأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٤ ٱلۡأَنۡفَالِ

অর্থঃ “হে নবী (সাঃ)! তোমার জন্য ও তোমাদের অনুসারী মুমিনদের জন্য (সর্বক্ষেত্রে) আল্লাহই যথেষ্ট।” [আনফল -৬৪]

আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ ٣ ٱلطَّلَاقِ

অর্থঃ “আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য নিস্কৃতির পথ করে দিবেন।” [ত্বালাক -৩]

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি (আল্লাহর এ বাণী) বলেনঃ

حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَ نِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ آلِ عِمۡرَانَ

অর্থঃ “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং মঙ্গলময় কর্মবিধায়ক।” (সূরা আল-ইমরানঃ ১৭৩)। এ কথা ইবরাহীম (আঃ) তখন বলেছিলেন, যখন তাঁকে অগ্নিকুণ্ড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর মুহাম্মদ (সাঃ) এ কথা বলেছিলেন তখন, যখন তাঁকে বলা হলোঃ

ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدۡ جَمَعُواْ لَكُمۡ فَٱخۡشَوۡهُمۡ فَزَادَ هُمۡ إِيمَٰنٗا وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ آلِ عِمۡرَانَ

অর্থঃ “যাদেরকে লোকেরা বলেছিলঃ নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য সেই সব লোক সমাবেত হয়েছে বহু সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে; অতএব তোমরা তাদেরকে ভয়কর; কিন্তু ইহা তাদের বিশ্বাস কে দৃঢ়তর করিয়াছিল এবং তাহারা বলেছিল, আল্লহই আমাদের জন্য যথেষ্ট; তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক!” [সূরা আল-ইমরান- ১৭৩] (বুখারী ও নাসাঈ)

ব্যাখ্যাঃ

* আল্লাহর উপর ভরসা করা নির্ভেজাল ইসলামের শর্ত। সে কথাই অত্র অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার শরয়ী মর্মার্থ হচ্ছে এটা একটি বিরাট মানের আন্তরিক ইবদাত, বান্দা তার সামগ্রিক কাজে আল্লাহর উপর আস্থাশীল থাকবে এবং সবকিছুকেই তার উপর সোপর্দ করবে ও সাথে সাথে কারণগুলি নিজে সম্পাদন করবে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসাকারী ঐ ব্যক্তি যে কারণ ও মাধ্যম গ্রহণ করার পর উক্ত ব্যাপারকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে দিবে এবং এ বিশ্বাস রাখবে যে, এ কারণে উপকার সাধন আল্লাহরই হুকুমে হতে পারে আর যে কারণ ও মাধ্যম গ্রহণ করা হয়েছে সবকিছুই তার সাহায্য ও তাওফীকেই হয়ে থাকে। অতএব, খাঁটি আন্তরিক ইবাদত হলো তাওয়াক্কুল। গাইরুল্লাহর উপর ভরসা করা দুই প্রকারঃ প্রথমটি হচ্ছে কোন ব্যক্তি এমন কোন মাখ্‌লুক তথা সৃষ্টি জীবের উপর এমন বিষয়ে ভরসা বা আস্থা রাখে যার উপর সে ক্ষমতা রাখে না বরং আল্লাহই সে ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। যেমন- পাপ মার্জনা করা অথবা সন্তান দান করা, অথবা ভাল চকরি প্রদান করা। এগুলো সচারাচর কবর পূজকদের মাঝে দেখা যায়। এটা মূলতঃ শিরকে আকবার বা বড় শিরক যা তাওহীদ পরিপন্থী। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কোন ব্যক্তি এমন কোন মাখলুকের উপর এমন বিষয়ে ভরসা করে যার উপর সে ক্ষমতা রাখে। এটা শিরকে আসগার বা ছোট শিরক। যেমন- কেউ যদি বলে আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, তোমার উপরও। এমনকি একথাও বলা জায়েয হবে না যে আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, অতঃপর তোমার উপর, কেননা তাওয়াক্কুল এমন একটি বিষয়ে যেখানে কোন মাখলুকের কোন অংশ নেই। আর তাওয়াক্কুল বা ভরসার প্রকৃত অর্থ তো ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে তাওয়াক্কুলের মর্ম হলো, স্বীয় কার্যাবলী আল্লাহর দিকে সোপর্দ করা যার হাতেই রয়েছে সমস্ত কিছুর অধিকার মাখলুকের নিকট কোন অধিকার বা সামর্থ নেই। তবে মাখলুক কারণ হতে পারে। অতএব এর অর্থ এ নয় যে কোন মাখলুকের উপর ভরসা করা যাবে। وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوا এটিই প্রমাণ করে যে, এর পূর্বে আসার অর্থই হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা ওয়াজিব এবং যেহেতু তাওয়াক্কুল একটি ইবাদত সুতরাং তা একমাত্র আল্লাহর জন্য হবে। যেহেতু আল্লাহ বালেছেন ‘যদি তোমরা মুমিন হও সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হয় যে এককভাবে আল্লাহর উপর ভরসা না করলে ঈমান সঠিক হবে না।

অত্র আয়াতে বলা হয়েছে, فَتَوَكَّلُوٓاْ এর পূর্বে وَعَلَى ٱللَّهِ এসেছে অর্থাৎ وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ কে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ মুমিনগণ শুধুমাত্র তাদের রবের উপরই ভরসা করে। সুতরাং এটা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অর্থাৎ হে নবী তোমার ও তোমার অনুসারী মুমিনদের ভরসার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট অন্যের উপর ভরসা করার প্রয়োজন নেই। এজন্যে অন্য এক আয়াতেও আল্লাহ্‌ বর্ণনা করেন, وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ তাওয়াক্কুল তখনই পুরোপুরি বুঝা সম্ভব হবে যখন তাওহীদে রুবুবিয়্যাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান থাকবে। কেননা যখন কেউ জানবে আল্লাহই এই বিশাল ভূ-মণ্ডলে ও নভোমণ্ডলের একমাত্র স্রষ্টা এবং তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন তাওয়াক্কুল বা ভরসা আরও দৃঢ় হবে।

حسبنا اللَّه এটা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর একটি মহান বাণী। বান্দা যখন আল্লাহর উপর পুরো আস্থা রাখবে তখন আল্লাহ তার সহায় হবেন যদিও আসমান ও জমিন সমপরিমাণ তার উপর বিপদ থাক না কেন, আল্লাহ অবশ্যই তার পথ তৈরি করে দিবেন।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করা ফরযের অন্তর্ভুক্ত।

০২। আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করা ঈমানের শর্ত।

০৩। সূরা আনফালের ২ নং আয়াতের তাফসীর

০৪। আয়াতটির তাফসীর এর শেষাংশেই রয়েছে।

০৫। সূরা তালাকের ৩নং আয়াতের তাফসীর।

০৬। حسبنا الله কথাটি ইব্‌রাহীম (আঃ) ও মুহাম্মদ (সাঃ) বিপদের সময় বলার কারণে এর গুরুত্ব ও মর্যাদা।


অধ্যায়-৩৩

আল্লাহ তা‘আলার পাকড়াও থেকে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত নয়

আল্লাহ তা’আলা বাণীঃ

أَفَأَمِنُواْ مَكۡرَ ٱللَّهِ ۚ فَلَا يَأۡمَنُ مَكۡرَ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩٩ ٱلۡأَعۡرَافِ

অর্থঃ “তারা কি আল্লাহর পাকড়াওয়ের ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছে? বস্তুতঃ আল্লাহর পাকড়াও থেকে তারাই নির্ভয় হতে পারে যাদের ধ্বংস ঘনিয়ে আসে।” * [সূরা আল-‘আরাফ-৯৯]

আল্লাহ পাক আরও বলেনঃ

وَمَن يَقۡنَطُ مِن رَّحۡمَةِ رَبِّهِۦٓ إلَّا ٱلضَّآلُّونَ ٥٦ ٱلۡحِجۡرِ

অর্থঃ “তিনি বললেন, পালনকর্তার রহমত থেকে পথভ্রষ্টরা ছাড়া কে নিরাশ হয়।” [সূরা হিজর-৫৬] ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) কে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তার উত্তরে বলেন, কবীরা গুনাহ হলোঃ

((اَشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالْيَأْسُ مِنْ رَّوْحِ اللَّهِ، وَالأَمْنُ مِنْ مَّكْرِ اللَّهِ)) (مسند البزار، ح:۱۰۲ ومجمع الزوائد:۱۰۴/۱)

অর্থঃ “আল্লাহ পাকের সাথে শরীক করা, আল্লাহ পাকের রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহ পাকের পাকড়াও থেকে নির্ভয় হওয়া।”

((أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ: الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَالأَمْنُ مِنْ مَّكْرِ اللَّهِ، وَالْقُنُوطُ مِنْ رَّحْمَةِ اللَّهِ، وَالْيَأْسُ مِنْ رَّوْحِ اللَّهِ)) (مصف عبدالرزاق:۴۵۹/۱۰ ومعجم الكبير للطبر اني، ح:۸۷۸۳)

অর্থঃ “সবচেয়ে বড় গুনাহ হলোঃ আল্লাহ পাকের সাথে শরীক করা, আল্লাহ পাকের শাস্তি থেকে নির্ভিক হওয়া, আল্লাহ পাকের রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহ পাকের কুরুণা থেকে বঞ্চিত মনে করা।”

ব্যাখ্যাঃ

* অত্র অধ্যায়ে দুটি আয়াতের উল্লেখ আছে এবং আয়ত দুটির পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। প্রথমত আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুশরিকদের স্বভাব হল যে তারা আল্লাহর শাস্তির পাকড়াও থেকে নিজেদের নিরাপদ মনে করে অর্থাৎ তারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে না আর আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ মনে করা ভয় না পাওয়া ও ভয়-ভীতির ইবাদত পরিহার করারই ফল। অথচ ভয় একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তরিক ইবাদত। আয়াতে উল্লেখিত ‘মকর’ কৌশল অবলম্বনের তাৎপর্য হল, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্য যাবতীয় কাজ এমন সহজ করে দেন যে, সে এমন ধারণা করে ফেলে যে সে বর্তমানে সম্পূর্ণ নিরাপদ, তার আর কোন ভয় নেই। প্রকৃত পক্ষে এ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে অবকাশ দেয়া। আল্লাহ মানুষকে সবকিছুই দেন কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সে নিরাপদ রয়েছে। এ ব্যাপারে নবী (সাঃ) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, “যখন তোমরা দেখবে যে আল্লাহ কোন বান্দাকে শুধু দিয়েছেন অথচ সে সদা-পাপ কাজে লিপ্ত, তবে তোমরা জেনে রাখ যে আল্লাহ নিশ্চয় তাকে অবকাশ দিচ্ছেন।” আল্লাহ তা‘আলা এ কৌশল অবলম্বন তাদের সাথেই করে থাকেন যারা তাঁর নবী, অলীদের ও তাঁর দ্বীনের সাথে গোপনে চক্রান্ত ও ধোকাবাজির আশ্রয় নেয়। এ কৌশল অবলম্বন আল্লাহর পরিপূর্ণ গুণাবলী। কেননা এ সময় তিনি স্বীয় ইজ্জত, কুদরত ও প্রভাব প্রকাশ করেন।

এখানে আল্লাহ্‌ পথভ্রষ্টদের স্বভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যে তারা আল্লাহ্‌র রহমত ও মাগফিরাত থেকে নিরাশ ও উদাসীন। মোটকথা মুত্তাকিন এবং হেদায়াত প্রাপ্তদের গুণাবলী হচ্ছে যে তারা আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয় না অথচ আল্লাহ্‌কে তারা ভয়ও করে। আল্লাহ্‌কে ভয় করা বান্দাহর অপরিহার্য কর্তব্য আশা-আকাঙ্খা এবং ভয়ভীতি এ উভয় গুণের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ্‌র ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা থাকা ওয়াজিব। তবে অন্তরে ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খার মধ্যে কোনটি প্রাধান্য পাবে?

শারীরিক সুস্থ্য পাপীর জন্য ভয়-ভীতির দিক আশা-আকাঙ্খার চেয়ে প্রাধান্য পায়, আর মৃত্যুর সম্মুখীন অসুস্থর মধ্যে আশা-আকাঙ্খার দিক প্রাধান্য পায়। তবে সঠিক ও কল্যাণের পথে ধাবমান অবস্থায় ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা সমপর্যায়ে হয়ে থাকে। যেমনঃ আল্লাহর বাণী-

إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِى ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗا ۖوَكَانُواْ لَنَاخَٰشِعِينَ ٩٠ ٱلۡأَنبِيَاءِ

অর্থ- “তারা নেকীর কাজে দ্রুতগামী এবং আমাকে তারা আশা-আকাঙ্খা ও ভয়-ভীতির সাথে আহ্বান (ইবাদত) করে ও আমাকেই তারা ভয় করতে থাকে।” [সূরা আম্বিয়া-৯০]

আল্লাহর রহমত থেকে আশা-আকাংঙ্খার ইবাদত পরিত্যাগ করা হল নিরাশ হওয়া আর আল্লাহর ভয়-ভীতির ইবাদত ত্যাগ করা হল তাঁর শাস্তি থেকে নির্ভিক হওয়া। অতএব, উভয়টি বান্দার অন্তরে একত্রিত হওয়া ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত আর উভয়টি বান্দার অন্তর থেকে বিদায় হওয়া বা হ্রাস পাওয়া হলো পরিপূর্ণ তাওহীদের হ্রাস পাওয়া।

আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া অধিকাংশ লোকের মধ্যে বিদ্যমান। রহমত আল্লাহর নিয়ামত-অনুগ্রহসমূহ অর্জন ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি পাওয়া কে অন্তর্ভুক্ত করে। আর হাদীসে বর্ণিত শব্দ “রাওহ” দ্বারা উদ্দেশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপদাপদ থেকে মুক্তি পাওয়াই নেয়া হয়ে থাকে।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা ‘আরাফের ৯৯নং আয়াতের তাফসীর।

০২। সূরা হিজরের ৫৬নং আয়াতের তাফসীর।

০৩। আল্লাহ পাকের পাকড়াও থেকে নির্ভিক ব্যক্তির জন্য কঠোর শাস্তির বিধানের কথা।

০৪। আল্লাহ পাকের রহমত থেকে নিরাশ হওয়াকে কঠোরভাবে সাবধান করা হয়েছে।


অধ্যায়-৩৪

তাকদীরের [ফায়সালার] উপর ধৈর্যধারণ করা ঈমানের অঙ্গ *

আল্লাহ তা’আলার ইরশাদঃ

وَمَن يُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ يَهۡدِ قَلۡبَهُۥ ١١ ٱلتَّغَابُن

অর্থঃ “এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন।” [সূরা আত্‌ তাগাবুন-১১]

আলকামা (রাঃ) বলেন, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মুমিন, যে বিপদ আসলে মনে করে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে সে বিপদগ্রস্ত হয়েও সন্তুষ্ট থাকে এবং বিপদকে খুব সহজেই বরণ করে নয়।

সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ

((اِثْنَتَانِ فِي النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ: اَلطَّعْنُ فِي النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ)) (صحيح مسلم، الإيمان، باب إطلاق اسم الكفر على الطعن في النسب والنياحة، ح:۶۷، ومسند أحمد:۳۷۷/۲، ۴۴۱، ۴۹۶)

“মানুষের মধ্যে এমন দু’টি [খারাপ] স্বভাব রয়েছে, যার দ্বারা তার কুফরী প্রকাশ পায়। তার একটি হচ্ছে বংশ উল্লেখ করে খোটা দেয়া, আর অপরটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা।”

ইমাম বুখারী ও মুসলিম ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে মারফু হাদীসে বর্ণনা করেনঃ

((لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُوْدَ، وَشَقَّ الْجُيُبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ)) (صحيح البخاري، الجنائز، باب ليس منا من ضرب الخدود، ح:۱۶۹۷ صحيح مسلم، الإيمان، باب تحريم ضرب الخدود وشق الجيوب والدعاء بدعوى الجاهلية، ح:۱۰۳ ومسند أحمد:۳۸۶/۱، ۴۳۲، ۴۴۲)

“যে ব্যক্তি শোকের সময় চেহারাতে মারে, গলাবন্ধ ফাড়ে-চিরে ও জাহেলী প্রথার ন্যায় আহ্বান করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

((إذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، وَإِذَا أَرَادَ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَافِيَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ)) (جَامع الترمذي، الزهد، باب ما جَاء في الصبر على البلاء، ح:۲۳۹۶)

“আল্লাহ পাক যখন তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ কামনা করেন, তখন অতি দ্রুত দুনিয়াতেই তার [অপরাধের] শাস্তি প্রদান করেন। পক্ষান্তরে তিনি যখন তাঁর কোন বান্দার অকল্যাণ কামনা করেন, তখন দুনিয়াতে তার অপরাধের শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকেন, যেন কিয়ামতের দিন তাকে পূর্ণ শাস্তি দিতে পারেন।”

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

((إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلَاءِ وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَىٰ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلَاهُمْ فِمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ)) (جامع الترمذي، الزهد، باب ما جاء في الصبر على البلاء، ح:۲۳۹۶)

অর্থঃ “পরীক্ষা যত কঠিন হয়, পুরস্কার তত বড় হয়। আল্লাহ তা‘আলা যে জাতিকে ভালবাসেন, সে জাতিকে তিনি পরীক্ষা করেন। এতে যারা সন্তুষ্ট থাকেন, তাদের উপর আল্লাহও সন্তুষ্ট থাকেন।” [তিরমিযী]

ব্যাখ্যাঃ

* তাকদীরের উপর ধৈর্যধারণ ঈমানের অঙ্গ এবং এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সকল নির্দেশনাবলী পালনে ধৈর্যের প্রয়োজন হয়; তেমন- সকল নিষেধাবলীতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। তেমনি জাগতিক বিষয়ে তাকদীরের উপরও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। অতএব ধৈর্য তিন প্রকার- জিহবাকে নিয়ন্ত্রন, দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকা, মনকে নারাজ হওয়া থেকে বিরত রাখা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অসন্তষ্টি প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা।

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তার অন্তরকে হেদায়েত দান করেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে আল্লাহ তাকে ইবাদতের উপর ধৈর্যধারণের ও ভাগ্যের উপর ক্রোধ হওয়া থেকে বিরত রাখবেন। বিপদাপদে পতিত হওয়া তাকদীরেরই অন্তর্ভুক্ত। আর তকদীর আল্লাহর হিকমতের উপরে হয় এবং আল্লাহর হিকমতের দাবীই হলো, প্রত্যেক কাজকে তার উপযুক্ত ও ভাল স্থানেই স্থাপন করা। যখন কোন ব্যক্তির বিপদ ঘটবে তার মঙ্গল যেন সে ধৈর্যধারণ করে। কিন্তু যদি সে ক্রোধ প্রকাশ করে তবে তাতে তার পাপ হবে।

দুটি কুফরী স্বভাব এমন যা অধিকাংশ লোকের মধ্যে বিদ্যমান আছে এবং তা অবশিষ্ট থাকবেঃ (১) বংশের খোটা দেয়া এবং (২) মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা ধৈর্যের পরিপন্থী। অথচ সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ধৈর্য হলো- চেহারাতে মারা, বুক চাপড়ানো ইত্যদি থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিরত রাখা। মুখ দ্বারা আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা থেকে বিরত থাকা। উক্ত স্বভাব কুফরী হওয়ার অর্থ এ নয়, যে এগুলি করলে সে এমন কাফের হয়ে গেল যে মিল্লাত থেকে একেবারে বেরিয়ে গেল রবং যে এ সমস্ত কর্মে লিপ্ত হল সে কুফরীর স্বভাবে লিপ্ত হল ও কুফরের একটি অংশে পতিত হল।

মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা ও উল্লেখিত কাজগুলি করা সবই কবীরা গুনাহ্‌ ফলে আমরা বলব ধৈর্য ত্যাগ করা ক্রোধ প্রকাশ করা কবীরা গুনাহ। যে কোন পাপে ঈমানের ঘাটতি যায় ঈমান আনুগত্যের মাধ্যমে বর্ধিত হয় পাপের কারণে ঈমান হ্রাস পায় আর ঈমান হ্রাস পেলে তাওহীদ হ্রাস পাবে। বরং ধৈর্য পরিত্যাগ করা হলো, আবশ্যকীয় পরিপূর্ণ তাওহীদের পরিপন্থী। হাদীসে বর্ণিত “আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়” অর্থ উক্ত কর্মগুলি কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।

উক্ত হাদীসে আল্লাহর এক বড় হিকমতের বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ হিকমত যখন বান্দার মাথায় ধরবে তখন সে ধৈর্যকে এক মহা আন্তরিক ইবাদত জ্ঞান করে নিজে সে গুণে গুণান্বিত হবে এবং আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীরের উপর সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করতঃ অসন্তুষ্টিকে বর্জন করবে। অনেক সালফে সালেহীন বিপদে ও কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত না হলে নিজেদের উপর শেকায়াত করতেন যে হয়ত আমার পাপ বেশি হয়ে গেছে বলে আল্লাহ কোন বিপদ দিচ্ছেন না।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা তাগাবুন এর ১১নং আয়াতের তাফসীর।

০২। বিপদে ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা ঈমানের অঙ্গ।

০৩। কারো বংশের প্রতি অপবাদ দেয়া বা দুর্নাম করা কুফরীর শামিল।

০৪। যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে, গালে-চাপড়ায়, জামার আস্তিন ছিড়ে ফেলে এবং জাহেলী যুগের কোন রীতি-নীতির প্রতি আহ্বান জানায়, তার প্রতি কঠোর শাস্তির বিধানের কথা।

০৫। বান্দার মঙ্গলের প্রতি আল্লাহর ইচ্ছার নিদর্শন।।

০৬। বান্দার প্রতি আল্লাহর অমঙ্গলেচ্ছার নিদর্শন।

০৭। বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালবাসার নিদর্শন।

০৮। আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া হারাম।

০৯। বিপদে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকার ফজিলত।


অধ্যায়-৩৫

রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা) প্রসঙ্গে শরীয়তের বিধান
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

قُلۡ إِنَّمَآ أَنَاْ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰ إِلَىَّ أَنَّمَآ إِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞ فَمَنۡ كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَايُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَاۢ ١١٠ ٱلۡكَهۡف

অর্থঃ “তুমি বলঃ আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মা’বূদই একমাত্র মা’বূদ; সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে।” [সূরা কাহাফ-১১০]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

((أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ مَعِيَ فِيهِ غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ)) (صحيح مسلم، الزهد والرقائق، باب الرياء، ح:۲۹۸۵)

“আমি অংশীদারদের শিরক (অর্থাৎ অংশিদারিত্ব) থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন কাজ করে আর ঐ কাজে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি (ঐ) ব্যক্তিকে এবং শিরককে তথা অংশিদারকে ও অংশীদারিত্বকে প্রত্যাখ্যান করি”

[মুসলিম] আবু সঈদ (রাঃ) থেকে অন্য এক মারফু হদীসে বর্ণিত আছেঃ

((أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ؟ قَالُوا: بَلَىٰ يَارَسُولَ اللَّهِ! قَالَ: الشِّرْكُ الْخَفِيُّ يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلَوٰتَهُ لِمَا يَرَىٰ مِنْ نَّظَرِ رَجُلٍ )) (مسند أحمد:۳۰/۳ وسنن ابن ماجه، الزهد، باب الرياء والسمعة، ح:۴۲۰۴)

“আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ে সংবাদ দিব না, যে বিষয়টি আমার কাছে মসীহ দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তা হচ্ছে খফী বা গুপ্ত শিরক। (আর এর উদাহরণ হচ্ছে] একজন মানুষ দাঁড়িয়ে শুধু এ জন্যই তার সালাতকে খুব সুন্দরভাবে আদায় করে যে, কোন মানুষ তারা সালাত দেখছে (বলে সে মনে করছে)” [আহমাদ]

ব্যাখ্যাঃ

* রিয়া তথা লোক দেখানো ইবাদতের কঠোরতা সম্পর্কে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। “রিয়া” চোখ দ্বারা দেখা অর্থে অর্থাৎ মানুষ কোন নেকীর কাজ করার সময় এমন ইচ্ছা করবে যে তাকে লোক এমতাবস্থায় যেন দেখে এবং তার প্রশংসা করে। রিয়া দুই প্রকারঃ প্রথমটি হচ্ছে মুনাফিকদের রিয়া, যেমন তারা মনের ভিতরে কুফর গোপন রেখে ইসলাম প্রকাশ করে শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য এটা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বড় ধরনের কুফুরী। দ্বিতীয় রিয়া হচ্ছে যে কোন মুসলমান তার কিছু আমল সম্পাদন করবে কিন্তু উদ্দেশ্য হবে লোক দেখানো এটাও শিরক তবে তা ছোট ধরনের শিরক এবং তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী।

‘উক্ত আয়াতে সব ধরনের শিরককে নাকচ করা হয়েছে। লোক দেখানো বা লোক শুনানো সকল প্রকার ইবাদতও শিরকের আওতায় পড়বে।

এ হাদীস রিয়া মিশ্রিত আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণ না হওয়ার দলীল বরং তা আমলকারীর দিকেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। যদি কোন ইবাদত শুরু থেকেই রিয়া অর্থাৎ দেখানোর জন্য হয় তবে সমস্ত ইবাদতই বাতিল গণ্য হবে আর সে আমলকারী দেখানোর জন্য গুনাহগার হবে এবং ছোট শিরকে পতিত হয়। তবে যদি মূল ইবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে; কিন্তু আমলকারী তাতে রিয়া মিশ্রণ করে ফেলে অর্থাৎ যেমন কোন ব্যক্তি ফরয নামায আদায় করতে এসে নামাযের রুকু, সিজদাহ লম্বা করে, তাসবীহ বেশি বেশি পড়ে তবে এর ফলে উক্ত ব্যক্তি গুনাহগার হবে এবং তার ততটুকু ইবাদত বাতিল হবে যতটুকুতে সে রিয়া মিশ্রন করেছে। এতো দৈহিক ইবাদতের অবস্থা। আর যদি আর্থিক ইবাদত হয় তবে সর্ম্পূণ নষ্ট হয়ে যাবে। أشرك معى فيه غيرى অর্থাৎ “যে ব্যক্তি স্বীয় আমলে আমার সাথে অন্যকেও অন্তর্ভুক্ত করলো (তা আল্লাহ তা ‘আলার নিকট কবুল হয় না)।” এমন আমলই (আল্লাহ তা ‘আলা) কবুল করে থাকেন যা একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে।

রিয়া দাজ্জালের ভয়াবহতা থেকেও মারাত্মক তার কারণ হচ্ছে দাজ্জালের ফিতনার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট সে ব্যাপারে নবী (সাঃ) বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু রিয়া মানুষের মনকে আক্রান্ত করে যা সংরক্ষণ অতীব কঠিন আর তা মানুষকে ধীরে ধীরে আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে মানুষের দিকে ধাবিত করে। ফলে নবী (সাঃ) এটাকে দাজ্জালের ভয়াবহতা থেকে বেশি ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা কাহাফের এর ১১০নং আয়াতের তাফসীর।

০২। নেক আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক ক্রটি হচ্ছে নেক কাজ করতে গিয়ে আল্লাহ ছাড়াও অন্যকে খুশী করার নিয়াতের মানসিকতা।

০৩। এর [অর্থাৎ শিরক মিশ্রিত নেক আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার] অনিবার্য কারণ হচ্ছে, আল্লাহর কারো মুখাপেক্ষী না হওয়া। [এজন্য গাইরুল্লাহ্ মিশ্রিত কোন আমল তাঁর প্রয়োজন নেই।]

০৪। আরো একটি কারণ হচ্ছে, আল্লাহ পাকের সাথে যাদেরকে শরীক করা হয়, তাদের সকলের চেয়ে আল্লাহ বহু গুণে উত্তম।

০৫। রাসূল (সাঃ) এর অন্তরে রিয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের উপর ভয় ও আশংকা।

০৬। রাসূল (সাঃ) রিয়ার ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, একজন মানুষ মূলতঃ সালাত আদায় করবে আল্লাহরই জন্যে। তবে সালাতকে সুন্দরভাবে আদায় করবে শুধু এজন্য যে, সে মনে করে মানুষ তার সালাত দেখছে।


অধ্যায়-৩৬

নিছক পার্থিব স্বার্থে কোন কাজ করা শিরক *

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَ لَا يُبۡخَسُونَ ١٥ أُوْلَٰٓۤئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِى ٱلۡأَخِرَةِ إلَّا ٱلنَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِلٌ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٦ هُود

অর্থঃ “যারা শুধু পার্থিব জীবন ও এর জাঁকজমক কামনা করে, আমি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মগুলি (-র ফল) দুনিয়াতেই পরিপূর্ণরূপে প্রদান করে দেই এবং দুনিয়াতে তাদের জন্যে কিছুই কম করা হয় না। এরা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখিরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই, আরা তারা যা কিছু করেছিল তা সবই আখিরতে অকেজো হবে এবং যা কিছু করেছে তাও বিফল হবে।” [সূরা হূদ-১৫-১৬]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ

((تَعِسَ عَبْدُالدِّينَارِ، تَعِسَ عَبْدُالدِّرْهَمِ، تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِصَةِ، تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيلَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَّمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلَا انْتَقَشَ، طُوْبَىٰ لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ، مُغْبَرَّةٍ قَدْمَاهُ، إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَّهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ)) (صحيح البخاري، الجهاد، باب الحراسة في الغزو في سبيل اللَّه، ح:۲۸۸۷)

“দীনার ও দিরহাম অর্থাৎ সম্পদের পূজারীরা ধ্বংস হোক। রেশম পূজারী (পোশাক-বিলাসী) ধ্বংস হোক। যাকে দিলে খুশী, না দিতে পারলে রাগন্বিত হয় সে ধ্বংস হোক, তার আরো করুণ পরিণতি হোক, কাঁটা-বিধলে সে তা খুলতে সক্ষম না হোক (আর্থাৎ বিপদ থেকে উদ্ধার না পাক) সে বান্দার সৌভাগ্য যে আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছে, মাথার চুলগুলোকে এলোমেল করেছে আর পদযুগলকে করেছে ধুলিমলিন। তাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয় সে তা যথাযথ পালন করে। সেনাদলের শেষ ভাগে তাকে নিয়োজিত করলে সে শেষ ভাগেই লেগে থাকে। সে অনুমতি প্রার্থনা করলে তাতে অনুমতি দেয়া হয় না। তার ব্যাপারে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না।”

ব্যাখ্যাঃ

* নিছক পার্থিব স্বার্থে কোন কাজ করা শিরকে আসগার তথা ছোট শিরক।

অত্র আয়তে কারীমা যদিও কাফেরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে যাদের মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ কিন্তু আয়াতের ভাবার্থ দ্বারা বুঝা যায় যে যারাই তাদের ‘আমল দ্বারা দুনিয়া অর্জন করতে চাইবে তারাও এই হুকুমের আওতায় পড়বে। বান্দা যে সমস্ত কাজ দুনিয়া অর্জনের লক্ষ্যে করে তা দু’প্রকারঃ প্রথমটি শুধু দুনিয়া অর্জনের জন্যেই কোন আমল সম্পাদন করা এবং পরকালের উদ্দেশ্যে না করা। যেমন- সালাত, রোজা ইত্যাদি আমল শুধু দুনিয়ার স্বার্থে সম্পাদন করা তবে উক্ত ব্যক্তি মুশরিক বলে বিবেচিত হবে। দ্বিতীয় প্রকার যে কাজগুলোর ব্যাপার শরীয়ত উৎসাহ প্রদান করেছে যেমন আত্মীয়তা রক্ষা করা, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ইত্যাদি, যখন এরূপ কাজ শুধু মাত্র দুনিয়ার লক্ষেই করা হবে; বরং আখিরাতের কোন উদ্দেশ্য থাকবে না তখনও তা শিরকের পর্যায়ভুক্ত হবে। কিন্তু যখন দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়টিই উদ্দেশ্য হবে সেটা বৈধ বলে গণ্য হবে। অত্র আয়াতের আলোকে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি মাল উপার্জনের লক্ষ্যে সৎ কাজ করে সেও অত্র বিধানের আওতায় পড়বে; যেমন ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে শুধু চাকুরীর জন্য এবং দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য, তার উদ্দেশ্য এ নয় যে সে এ বিদ্যার মাধ্যমে নিজের অজ্ঞতা দূর করবে এবং জান্নাত লাভ করবে ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে তবে তারও বিধান একই রূপ হবে।

ঠিক যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন আমল করবে এবং কোন ব্যক্তি সৎকাজ করল অথচ ঈমান ভঙ্গকারী পাপে সে জড়িত থাকল তবে সেও অত্র বিধানের আওতায় পড়বে। অর্থাৎ সে মুমিন থাকবে না। যদিও দাবী করে যে সে মুমিন কিন্তু সে তার দাবীতে সত্য নয় কেননা সে যদি সত্যবাদী হত তবে আল্লাহকে এক সাব্যস্ত করত।

এখন কেউ যদি দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে নবী (সাঃ) তাকে আব্দুদ দীনার বা দীনারের বান্দা বা পূজারী বলেছেন। এখান থেকে বুঝা যায় যে, দাসত্ব্যের বিভিন্ন স্তর আছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ছোট শিরক পর্যায়ের দাসত্ব। বলা হয়ে থাকে, অমুক ব্যক্তি ঐ বস্তুর পূজারী। কেননা সে বস্তুই তার কার্যক্রমের কারণ। আর এ কথাও বিদীত যে পূজারী আপন প্রভূর আনুগত্যই করে থাকে এবং তার প্রভূ তাকে যে দিকে ধাবিত হতে বলবে সেদিকেই সে ধাবিত হবে।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। আখেরাতের আমল দ্বারা মানুষের দুনিয়া হাসিলের ইচ্ছা।

০২। সূরা হূদের ১৫ ও ১৬ নং আয়াতের তাফসীর।

০৩। একজন মুসলিমকে সম্পদ ও পোশাকের বিলাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা।

০৪। উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা, বান্দাকে দিতে পারলেই খুশি হয়, না দিতে পারলে অসন্তুষ্ট হয়।

০৫। দুনিয়াদারকে আল্লাহর নবী এ বদদু’আ করেছেন, ‘সে ধ্বংস হোক, সে অপমানিত হোক বা অপদস্ত হোক।’

০৬। দুনিয়াদারকে এ বলেও অভিসম্পাত করেছেন, ‘তার গায়ে কাঁটা বিদ্ধ হোক এবং তা সে খুলতে না পারুক।’

০৭। হাদীসে বর্ণিত দায়িত্ব পালনকারী মুজাহিদের প্রশংসা।


অধ্যায়-৩৭

যে ব্যাক্তি আল্লাহর হালালকৃত জিনিস হারাম এবং হারামকৃত জিনিসকে হালাল করল, আলেম, বুযুর্গ ও নেতাদের অন্ধভাবে আনুগত্য করল, সে মূলতঃ তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করল। *

ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

((يُوْشِكُ أَنْ تَنْزِلَ عَلَيْكُمْ حِجَارَةٌ مِّنَ السَّمَاءِ أَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ سَلى للَّهُ عليه وَسلم وَتَقُولُونَ قَالَ أَبُوبَكْرٍ وَّعُمَرُ)) (مسند أحمد:۳۳۷/۱)

“তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কারণ, আমি বলছি, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, অথচ তোমরা বলছো, আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) বলেছেন।”

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিঃ) বলেন, ‘ঐ সব লোকদের ব্যাপারে আমার কাছে খুবই অবাক লাগে, যারা হাদীসের সনদ ও সিহ্‌হাত [বিশুদ্ধতা] অর্থাৎ হাদীসের পরম্পরা ও সহীহ হওয়ার বিষয়টি জানার পরও সুফইয়ান সাওরীর মতকে গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেনঃ

ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرْبَابٗامِّن دُونِ ٱللَّهِ ٣١ ٱلتَّوۡبَة

অর্থঃ “তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তা রূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে।” [সূরা তাওবা- ৩১]

তখন আমি নবীজিকে বললাম, আমারাতো তাদের ইবাদত করি না। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা আল্লাহর হালাল ঘোষিত জিনিসকে তারা হারাম বললে, তোমরা কি তা হারাম বলে গ্রহণ করো না? আবার আল্লাহর হারাম ঘোষিত জিনিসকে তারা হালাল বললে, তোমরা কি তা হলাল বলে গ্রহণ করো না? তখন আমি বললাম, ‘হাঁ। তিনি বললেন, এটাই তাদের ইবাদত (করার মধ্যে গণ্য) [আহমাদ ও তিরমিযি] এবং ইমাম তিরমিযি হাসান বলেছেন।

ব্যাখ্যাঃ

* অত্র অধ্যায় এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাওহীদের চাহিদা ও দাবী এবং কালেমা তথা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর উপকরণ সংক্রান্ত বর্ণনা হয়েছে। নিরঙ্কুশ আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর যা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। সকল আনুগত্য এবং অনুসরণ কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-কেই করতে হবে একথটি সুস্পষ্ট বেশ শক্তকেরই উল্লেখ করে এ অধ্যায়ের শিরোনাম করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হলে তা হবে রবের প্রতি শিরক করা। আলিম উলামাদের কাজ কুরআন ও সুন্নাহ তথা কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী মানুষকে আল্লাহর বিধান সুস্পষ্ট করে বর্ণনা। আর ইস্তিহাদী বিষয় কুরআন ও সহীহ হাদীসের মতো নয়। এটা সময়, যুগ, অবস্থা ও দৃষ্টিকোন অনুযায়ী বিভিন্ন হতে পারে। এবং ইস্তিহাদ ভুলও হতে পারে। ইস্তিহাদ হতে হবে কুরআন ও সহীহ হাদীসের নিরিখে; আর তা কখনও নিজেস্ব বা গোষ্টি বা দলিয় নিন্তাচেতনা থেকে বা স্বার্থ কেন্দ্রীক হবে না। তাই এটাকে কোন ইসলামের স্থায়ী আইন হিসাবে গন্য করা যায় না। তাই মুস্তাহিদ ও আলিম উলামাদেরকে অন্ধের মতো অনুসরণ করা যাবে না।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর কথার মর্মার্থ হচ্ছে যে, নবী (সাঃ) -এর কথার বিপরীত কারো কথা গ্রহণযোগ্য হবে না, যদিও তিনি আবু বকর (রাঃ) বা উমর (রাঃ) হোন না কেন। অবস্থা যদি এমনই হয় তবে অন্যের কথা রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) এর সামনে (মুকাবেলায়) কিভাবে পেশ করা যেতে পারে?

কারও কথার কারণে নবী (সাঃ) এর কথা যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়। যেমনঃ আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের কথা বলেছেন- “দলীল-প্রমাণ থাকা সত্বেও তারা তাদের ইচ্ছাধীন বক্রতা অবলম্বন করল আল্লাহও শস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিয়েছেন।”

ধর্মীয় নেতাদের হালাল-হারামের ব্যাপারে অনুসরণ দু’প্রকার। প্রথমটি ধর্মীয় নেতাদের বা উলামাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দ্বীন পরিবর্তনে অনুসরণ অর্থাৎ হালাল জিনিসকে হারাম এবং হারাম জিনিসকে হালাল মেনে নেয়া শুধু তাদের ধর্মীয় নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সম্মান ও তাদের আনুসরণের জন্য অথচ সে জানে যে এটা হারাম। এটাকে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে তারা ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতদেরকে রব হিসাবে বরণ করে নিয়েছিল। এটা বড় ধরনের কুফরী এবং শিরকে আকবার এবং তা হলো আল্লাহ ব্যতীত অন্যের আনুগত্য মূলক ইবাদত পালন করা। দ্বিতীয় প্রকারটি হচ্ছে ধর্মীয় নেতাদের হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বলার ব্যাপারে তাদের অনুসরণ করা। অথচ সে বুঝে এর জন্য সে পাপী এবং সে তার গুনাহকে স্বীকার করে কিন্তু সে পাপের প্রতি আসক্তি বা তাদের নৈকট্য পাওয়ার আসক্তি হওয়াই তাদের অনুসরণ করে থাকে। অতএব এ সমস্ত লোকেরা হলো গুনাহগার। সম্মানিত লেখক এখানে সূফীদের ত্বরীকা, সূফীদের সীমালংঘন এবং সূফী সম্রাটদের বাড়াবাড়ির ব্যাপারে সতর্ক করেন। তারা তাদের পীরদের বশ্যতা স্বীকার করে এবং ঐ সমস্ত অলীর অনুসরণ করে যারা তাদের ধারণায় অলী, যারা প্রকৃত দ্বীনকে রদ-বদল করে ফেলে। আর এটাই হলো আল্লাহকে বাদ দিয়ে ঐ সকল বান্দাদেরকে রব বানিয়ে নেয়া

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা নূরের ৬৩ নং আয়াতের তাফসীর।।

০২। সূরা তাওবার ৩১ নং আয়াতের তাফসীর।

০৩। আদী বিন হাতেম ইবাদতের যে অর্থ অস্বীকার করেছেন, সে ব্যাপারে সতর্কীকরণ।।

০৪। ইবনে আব্বাস (রা) কর্তৃক আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত আর ইমাম আহমাদ (রহঃ) কর্তৃক সুফাইয়ান সওরীর দৃষ্টান্ত সম্পর্কে জানতে পারা।

০৫। অবস্থার পরিবর্তন মানুষেকে এমন পর্যয়ে উপনীত করে, যার ফলে পণ্ডিত ও পীর বুযুর্গের পূজা করাটাই তাদের কাছে সর্বোত্তম ইবাদত বলে গণ্য হয়। আর এরই নাম দয়া হয় ‘বেলায়েত।’ আহবার তথা পণ্ডিত ব্যক্তিদের ইবাদত হচ্ছে, তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। অতঃপর অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয়ে এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর ইবাদত করলো, সে সালেহ বা পূণ্যবান হিসাবে গণ্য হলো (ইহা পীর ও ওলী পুজারী মুশরিকদের প্রকৃত সত্যের বিপরীত অবস্থা)। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় অর্থে যে ইবাদত করলো অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ইবাদত করলো, সেই জাহেল বা মূর্খ হিসাবে গণ্য হলো (ইহাও পীর ও ওলী পুজারী মুশরিকদের প্রকৃত সত্যের বিপরীত অবস্থা)।


অধ্যায়-৩৮

ঈমানের দাবীদার কতিপয় লোকের অবস্থা।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ

أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يَزۡعُمُونَ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓاْ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ … ٦٠ ٱلنِّسَاءِ

অর্থঃ “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে তাগুতের দিকে নিয়ে ফয়সালা করতে চায়।” * [সূরা নিসা- ৬০]

আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ

وَقَدۡ أُمِرُوٓاْ أَن يَكۡفُرُواْ بِهِۚۦ وَيُرِيدُ ٱشَّيۡطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمۡ ضَلَٰلَاۢ بَعِيدٗا ٦٠ ٱلنِّسَاءِ

অর্থঃ “যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল, যেন তাকে অবিশ্বাস করে, এবং শয়তান ইচ্ছা করে যে, তাদেরকে সুদূর বিপথে বিভ্রান্ত করে।” [সূরা নিসা- ৬০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ

وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِى لۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١ ٱلۡبَقَرَةِ

অর্থঃ “এবং যখন তাদেরকে বলা হয়ঃ তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা তো শুধু শান্তি স্থাপনকারীই।” [সূরা বাকারা-১১]

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَلَا تُفۡسِدُواْ فِى ٱلۡأَرۡضِ بَعۡدَ إِصۡلَٰحِهَا ٥٦ ٱلۡأَعۡرَافِ

অর্থঃ “দুনিয়ায় শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের পর ওতে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।” [সূরা ‘আরাফ-৫৬]

আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আরো ইরশাদ করেনঃ

أَفَحُكۡمَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ يَبۡغُونَۚ ٥٠ ٱلۡمَائِدَةِ

অর্থঃ “তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফায়সালা কামনা করে।” [সূরা মায়েদা-৫০]

আব্দুল্লাহ বিন ওমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

((لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِّمَا جِئْتُ بِهِ)) (قال النووي في الأربعين، ح:۴۱ حديث صحيح رويناه في كتاب الحجة بإسناد صحيح)

“তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়।” (ইমাম নববী হাদীসটি সহীহ বলেছেন)

ইমাম শা‘বী (রহ) বলেছেন, একজন মুনাফিক এবং একজন ইহুদীর মধ্যে (একটি ব্যাপারে) ঝগড়া হচ্ছিল। ইহুদী বললো, ‘আমরা এর বিচার-ফায়সালার জন্য মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে যাবো, কেননা মুহাম্মাদ (সাঃ) ঘুষ গ্রহণ করেন না, এটা তার জানা ছিল। আর মুনাফিক বললো, ‘ফায়সালার জন্য আমরা ইহুদী বিচারকের কাছে যাব, কেননা ইহুদীরা ঘুষ খায়, এ কথা তার জানা ছিল। অবশেষে তারা উভয়েই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তারা এর বিচার ও ফয়সালার জন্য জোহাইন গোত্রের এক গণকের কাছে যাবে তখন এ আয়াত নাযিল হয়ঃ

أَلَمۡ تَرَ إِلَّذِينَ يَزۡعُمُونَ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ بِمَآ أُنۡزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنۡزِلَ مِن قَبۡلِكَ يُرِيدُنَ أَن يَتَحَاكَمُوٓاْ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ وَقَدۡ أُمِرُوٓاْ أَن يَكۡفُرُواْ بِهِۚۦ وَيُرِيدُ ٱلشَيۡطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمۡ ضَلَٰلَاۢ بَعِيدًا ٦٠ ٱلنِّسَاءِ

অর্থঃ “তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি, যারা ধারণা করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা নিজেদের মোকদ্দমা শয়তানের নিকট নিয়ে যেতে চায়, যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল, যেন তাকে অবিশ্বাস করে; এবং শয়তান ইচ্ছা করে যে, তাদেরকে সুদূর বিপথে বিভ্রান্ত করে।”

আরেকটি বর্ণনা মতে জানা যায়, ঝগড়া-বিবাদের লিপ্ত দু’জন লোকের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। তাদের একজন বলেছিল, মীমাংসার জন্য আমরা নবী (সাঃ) এর কাছে যাব, অপরজন বলেছিল কা’ব বিন আশরাফের কাছে যাবে। পরিশেষে তারা উভয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য ওমর (রাঃ) এর কাছে গেল। তারপর তাদের একজন ঘটনাটি তাঁর কাছে উপস্থাপন করলো। যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর বিচার ফয়সালার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারলো না, তাকে লক্ষ্য করে ওমর (রাঃ) বললেন, ঘটনাটি কি সত্যই এরকম? সে বললো, ‘হাঁ’। তখন ওমর (রাঃ) তরবারির আঘাতে লোকটিকে হত্যা করে ফেললেন।

ব্যাখ্যাঃ

* যেমন আল্লাহ তাঁর তাওহীদে রুবুবীয়াত ও তাওহীদে ইবাদতে একক ঠিক তেমনই বিধি বিধান ও হুকুম-ফয়সালাতেও তাঁকে এককভাবে মানতে হবে। সুতরাং অনুসরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর তাওহীদ এবং কালেমায়ে শাহাদত বাস্তবায়ন আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী হুকুম-ফয়সালা ছাড়া হবে না। জাহেলীয়াত যুগের বিধান তথা প্রথা এবং প্রাচীন কথ্যকাহিনীর কারণে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে পরিত্যাগ করা বড় ধরণের কুফরী হবে যা কালিমা তাওহীদকে বিনষ্ট করে দিবে। ইমাম মুহাম্মদ বিন ইব্রাহীম (রহঃ) তার গ্রন্থ ‘তাহ্‌কীমূল কাওয়ানীন’- এ উল্লেখ করেন যে নবী (সাঃ) এর উপর জিব্‌রাঈল আমিন মারফত নাযিলকৃত মহান আল্লাহর বিধানকে মানবরচিত বিধানের সমতুল্য মনে করা বড় ধারনের কুফুরী ও নাযিলকৃত বিধানের পরিপন্থী।

মূলতঃ যারা বিচার ফয়সালার জন্য তাদের (তাগুতের) কাছে যায়, তারা মিথ্যাবাদী তাদের ঈমানই নেই। আয়াতে বর্ণিত (يريدون أن يتحاكموا …) তারা চায় যে, আপন হুকুম ফয়সালা তাগুতের নিকট নিয়ে তার থেকে ফয়সালা করাবে। এ (يريدون) (তারা চায়) শব্দ দ্বারা এক গুরুত্বপূর্ণ কায়দার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আর তা হল তাগুতের নিকট থেকে ফয়সালা গ্রহণকারীর ঈমান তখন নাকচ হয়ে যায়, যখন সে স্বীয় ইচ্ছা ও আনন্দ চিত্তে তার থেকে ফয়সালা গ্রহণ করে ও তাকে অপছন্দ করে না। সুতরাং এক্ষেত্রেই ইচ্ছা-ইখতিয়ারকে একটি শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ তাগুতের নিকট থেকে স্বেচ্ছায় ফয়সালা গ্রহণ করা কুফরের হুকুম। (পক্ষান্তরে যদি তাকে তাগুত দ্বারা ফয়সালা করতে বা তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়, আর সে তা অপছন্দও করে তবে এমন নিরুপায় ব্যক্তি ঈমান মুক্ত হবে না।) وقد أمروا … তারা তাগুত ও তার ফয়সালার প্রতি কুফরী করতে আদিষ্ট অর্থাৎ তাগুত দ্বারা ফয়সালা করানোকে অস্বীকার করা এবং তার সাথে কুফরী করা শুধু ওয়াজিবই নয় বরং তা তাওহীদের এক অপরিহার্য অংশ ও আল্লাহর রুবুব্যিয়াতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আয়াতের এ অংশ দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহ (এর বিধানের প্রতি আনুগত এবং এ বিধান) ব্যতীত অন্যের দ্বারা ফয়সালা করানোর ইচ্ছা রাখা এবং তা গ্রহণ করা সরাসরি শয়তানী ইলহাম ও তার কুমন্ত্রণা দ্বারাই হয়ে থাকে।

“তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করো না”, আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্যের বিধান বাস্তবায়নে ও তাঁর সাথে শিরক করার মাধ্যমে বিপর্যয় ঘটে থাকে। পৃথিবীতে শরীয়ত ও তাওহীদের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিরক এর মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। অত্র আয়াতের মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা যায় যে মুনাফিকরা শিরকও এ জাতীয় গর্হিত কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে যদিও তারা বলে থাকে যে আমরাই শান্তি কামী।

“তারা কি বর্বর যুগের আইন চায়?” জাহেলী যুগের মানবরচিত আইনে সমাজ পরিচালীত হত এবং সেটাকে তারা শরীয়তের মতো বিধান মনে করত। আর তা মনে করার অর্থ হল, আল্লাহকে বাদ দিয়ে সেটাকেই অনুসরণযোগ্য মনে করা ও আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করা যা প্রকৃতপক্ষে অনুসরণের ক্ষেত্রে শিরক।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের তাফসীর এবং তাগুতের মর্মার্থ বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা।

০২। সূরা বাকারার ১১ নং আয়াতের তাফসীর।

০৩। সূরা আরাফের ৫৬ নং আয়াতের তাফসীর।

০৪। সূরা মায়েদার ৫০ নং আয়াতের তাফসীর।

০৫। এ অধ্যায়ে প্রথম আয়াত নাযিল হওয়া সম্পর্কে শা’বী (রহঃ) এর বক্তব্য।

০৬। সত্যিকারের ঈমান এবং মিথ্যা ঈমানের ব্যাখ্যা।

০৭। মুনাফিকের সাথে ওমর (রাঃ) এর ঘটনা।

০৮। প্রবৃত্তি যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) এর আনীত আদর্শের অনুগত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ ঈমানদার না হওয়ার বিষয়।


অধ্যায়-৩৯

আল্লাহর ‘আস্‌মা ও সিফাত’ [নাম ও গুণাবলী] অস্বীকারকারীর পরিণাম *

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ

كَذَٰلِكَ أَرۡسَلۡنَٰكَ فِىٓ أُمَّةٖ قَدۡخَلَتۡ مِن قَبۡلِهَآ أُمَمٞ لِّتَتۡلُوَاْ عَلَيۡهِمُ ٱلَّذِىٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَهُمۡ يَكۡفُرُونَ بِٱلرَّحۡمَٰنِۚ قُلۡ هُوَ رَبِّى لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلۡتُ وَإِلَيۡهِ مَتَابِ ٣٠ ٱلرَّعۡد

অর্থঃ “এই ভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির প্রতি যার পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে, তাদের নিকট আবৃত্তি করার জন্যে, যা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি, তথাপি তারা দয়াময়কে অস্বীকার করে; তুমি বল তিনিই আমার প্রতিপালক; তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য মা’বূদ নেই, তাঁরই উপর আমি নির্ভর করি এবং আমার প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে” [সূরা রা‘দ, ৩০]

সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে আলী (রাঃ) বলেনঃ “লোকদের এমন কথা বল, যা দ্বারা তারা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ সম্পর্কে) সঠিক কথা জানতে পারে। তোমরা কি চাও যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হোক?” ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) থেকে একটি হাদীস শুনে এক ব্যক্তি আল্লাহর গুণকে অস্বীকার করার জন্য একদম ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন তিনি বললেন, এরা এ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কি করে করল? তারা মুহকামের (বা সস্পষ্ট) আয়াত ও হাদীসের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখালো, আর মুতাশাবেহ (অস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসের ক্ষেত্রে) ধ্বংসাত্মক পথ অবলম্বন করলো? কুরাইশরা যখন রাসূল (সাঃ) এর কাছে (আল্লাহর গুণবাচক নাম) রহামনের কথা শুনতে পেল, তখন তারা “রহমান” গুণটিকে অস্বীকার করল। এ প্রসঙ্গেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে।

ব্যাখ্যাঃ

* অত্র অধ্যায়ের মূল গ্রন্থের সাথে সম্পর্ক দু’ধরনের; প্রথমটি হচ্ছে যে, ইবাদত তাওহীদের প্রমাণ পুঞ্জীর মাধ্যে নাম ও গুণের তাওহীদ ও অন্যতম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আল্লাহর নাম ও গুণ বিষয়ে কিছু অস্বীকার করা শিরক ও কুফুরী যা মানুষকে ধর্মচ্যুত করে। যখন প্রমাণিত হবে যে আল্লাহ তা’আলা কোন নাম বা গুণ নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন অথবা রাসূল (সাঃ) তা নির্ধারণ করেছেন কিন্তু তা সত্বেও কোন ব্যক্তি যদি তা অস্বীকার করে তবে সেটা কুফুরী হবে কেননা কিতাব ও সুন্নাতের প্রতি মিথ্যারোপ করা হল।

রহমান আল্লাহর নাম সমূহের একটি কিন্তু মক্কার মুশরিকগণ বলতো আমরা ইয়ামামা এর রহমান ছাড়া কাউকে রহমান হিসাবে জানি না। ফলে তারা রহমানকে অস্বীকার করত আর তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই অস্বীকার করা। রহমান রহমত গুণের অর্থে ব্যহৃত। আল্লাহর প্রত্যেক নামেই একটি গুণ অন্তর্ভুক্ত বরং আল্লাহর প্রত্যেক নামেই দুইটি বিষয় রয়েছে। প্রথম- আল্লাহ তা‘আলার স্বত্বা। দ্বিতীয়ত- তাঁর ঐ গুণ যার অর্থ ঐ নামই প্রকাশ করে থাকে। এজন্যে আমরা বলবঃ আল্লাহর প্রত্যেক নামেই আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে কোন গুণ অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ শব্দটি ইলাহ যার অর্থ ইবাদত থেকে নেয়া হয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ একমাত্র ইবাদতের যোগ্য।

“লোকদের এমন কথা বল যে ব্যাপারে তারা পরিচিত” দ্বারা বুঝা যায় যে, (লোকেদেরকে এমন কথা বলবে যা তারা বুঝে। অস্পষ্ট কথা পরিহার করবে) কিছু কিছু বিষয় (যা স্পষ্ট নয় সে) সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নাই। ফলে নাম এবং গুণবোধক তাওহীদের কিছু কিছু সূক্ষ্ম মাছাআলা (যা স্পষ্ট নয় সে) সম্পর্কে আলোচনা না করাই উত্তম, তবে মোটামুটিভাবে তার উপর ঈমান রাখা ওয়াজিব যা কুরআন ও সুন্নাতে প্রকশিত। কেননা আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে তারা (বিতর্ক সৃষ্টিকারিগণ) এমন কথা বলে থাকে যা বুঝা যায় না, যার ফলে তারা তা পুরাপুরি অস্বীকার করে ফেলে। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের বিশেষ করে উলামাদের উপর ওয়াজিব হল, তারা লোকদেরকে আল্লাহ যা বলেছেন ও তাঁর নবী যা খবর দিয়েছেন (সেসবের মনমতো অস্পষ্ট ব্যাখ্যা করে) তার প্রতি মানুষদেরকে কাফির না বানায়, অর্থাৎ তারা যেন লোকদেরকে এমন কিছু বর্ণনা না করে যা তারা বুঝতে পারবে না, ফলে তা হবে তাদের মিথ্যা সাব্যস্ত করার কারণ। (অর্থাৎ আল্লাহ সম্পর্কে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের যা বলেছেন কেবল তাই প্রচার কর। এবং আল্লাহ এবং তাঁর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে তিনি মানুষকে যে জ্ঞান দেন নাই বা জানান নাই তা সম্পর্কে আরও অগ্রসর হওয়া আনুমান ছাড়া আর কিছু নয় সে জন্য তা শিরক অথবা কুফরী হয়ে যেতে পারে)

আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীকে স্বীকার করতেই হবে কোন প্রকার উদাহরণ উপমা ব্যতীরেকেই। উল্লেখিত ব্যক্তি এই হাদীসকে একেবারে অপরিচিত ভেবে শুনামাত্র কেঁপে উঠে। তার এ অবস্থা হওয়ার কারণ হলো, সে বুঝেছিল আল্লাহর এই গুণে মাখলুকের সাথে সাদৃশ্য ও তুলনা হয়ে যায়, তাই সে উক্ত গুণ থেকে ভয় পেয়ে যায়। অথচ, প্রত্যেক মুসলামনের জন্য অপরিহার্য হল, যখনই আল্লাহ তা‘আলার কোন গুণ কুরআন ও হাদীস থেকে শুনবে তখন তার গুণাবলীকে ঐভাবেই সাব্যস্ত করতে হবে তাতে মাখলুকের সাথে কোন ভাবেই কোন সাদৃশ্য ও তুলনা জ্ঞাপন করা যাবে না এবং না তার নির্ধারিত ধরণ-আকৃতি বর্ণনা করার যাবে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরের অবস্থা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে বলেন- এরা কেমন যে, যখন তারা এমন কথা শুনে যে বিষয়ে তাদের জ্ঞন নেই তখন তাদের অন্তর নরম হয়ে যায় কিন্তু যখন তারা কুরআন ও সুন্নাহর এমন কথা শ্রবণ করে যা তদের বুঝে আসে না, তার প্রতি তারা ঈমান না রেখে তার অপব্যাখ্যা, অস্বীকার ও নাকচ করে থাকে। যার ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।

আল্লাহর কোন নাম বা গুণকে অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে তা বিশ্বাস না করা এবং যা কুফুরী।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। আল্লাহর কোন নাম ও গুণ অস্বীকার করা কুফরির শামিল।

০২। সূরা রা‘দের ৩০ নং আয়াতের তাফসীর।

০৩। যে কথা শ্রোতার বোধগম্য নয়, তা পরিহার করা।

০৪। অস্বীকারকারীর অনিচ্ছা সত্বেও যেসব কথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা সাবস্ত করার দিকে নিয়ে যায়, এর কারণ কি? তার উল্লেখ।

০৫। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর কোন একটি অস্বীকারকারীর ধ্বংস অনিবার্য।


অধ্যায়-৪০

আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করার পরিণাম *

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

يَعۡرِفُونَ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُنكِرُونَهَا وَأَكۡثَرُهُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٨٣ ٱلنَّحۡل

অর্থঃ “তারা আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহ চিনে, এরপর অস্বীকার করে এবং তাদের আধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল-৮৩]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ বলেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, কোনো মানুষের এ কথা বলা এ সম্পদ আমার, যা আমার পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তারাধিকার সূত্রে আমি পেয়েছি আ‘উন ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, কোন ব্যক্তির এ কথা বলা, অমুক ব্যক্তি না হলে এমনটি হতো না। ইবনে কুতাইবা এর ব্যখ্যায় বলেন, ‘মুশরিকরা বলে, “এটা হয়েছে আমাদের ইলাহ্‌দের সুপারিশের বদৌলতে।” আবুল আব্বাস যায়েদ ইবনে খালেদের হাদীসে যাতে একথা আছে, আল্লাহ পাক বলেনঃ

((إِنَّ اللَّهَ تَعَالَىٰ قَالَ: أَصۡبَحَ مِنۡ عِبَادِي مُؤۡمِنٌ بِي وَكَافِرٌ)) (صحيح البخاري، الأذان، باب يستقبل الإمام الناس إذا سلم، ح: ۸۴۲ وصحيح مسلم، الإيمان، باب بيان كفر من قال مطرنا بالنوء، ح:۷۱)

“আমার কোন বান্দার ভোরে নিদ্রা ভঙ্গ হয় মু’মিন অবস্থায়, আবার কারো ভোর হয় কাফির অবস্থায় হাদীসের শেষ পর্যন্ত পূর্বে উল্লেখ হয়েছে। তারপর তিনি বলেন, এ ধরনের অনেক বক্তব্য কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। যে ব্যক্তি নেয়ামত দানের বিষয়টি গাইরুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, আল্লাহ তার নিন্দা করেন।”

উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কোন কোন সালফে সালেহীন বলেন, বিষয়টি মুশরিকদের এ কথার মতোই- অঘটন থেকে বাঁচার কারণ হচ্ছে অনুকুল বাতাস, আর মাঝির বিচক্ষণতা; এ ধরনের আরো অনেক কথা রয়েছে যা সাধারণ মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত।

ব্যাখ্যাঃ

* যাবতীয় নিয়ামতকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা বান্দার প্রতি ওয়াজিব। এর মাধ্যমেই তাওহীদ পূর্ণতা লাভ করে। কোন প্রকার নিয়ামতকে আল্লাহ ছাড়া কারো সাথে সম্পৃক্ত করা তাওহীদ পূর্ণতায় ঘাটতির সৃষ্টি করে এবং তা ছোট শিরকের পর্যায়ে পড়ে।

“এ সম্পদ আমার, যা আমার পূর্বপুরুষ থেকে উত্তারধিকার সূত্রে পেয়েছি।” পূর্ণ তাওহীদের পরিপন্থী কথাও এক ধরনের শিরক। কেননা এখানে সম্পদকে নিজের দিকে ও পূর্বপুরুষদের দিকে সম্বোধন করা হয়েছে অথচ এ সম্পদ আল্লাহর নিয়ামত স্বরূপ তার পূর্বপুরুষকে এবং পরবর্তীতে তাকে দিয়েছন যে সে পৈত্রিক সম্পত্তির মাধ্যমে তা অর্জন করেছেন। তোমার নিকট পর্যন্ত সম্পদ পৌঁছাতে তোমার পিতা শুধু একজন মাধ্যম ফলে, পিতা তার ইচ্ছামত সম্পদ বন্টন করতে পরেন না কেননা বাস্তবে মাল তার নয়।

“আমুক ব্যক্তি না হলে এমনটি হতো না” যেমন কেউ বলে- এই পাইলট যদি না হতো তবে অবশ্যই আমরা ধ্বংসের মুখে নিপতিত হতাম। এ ধরনের কথা সম্পূর্ণ নাজায়েয যার মধ্যে কোন কর্মের সম্পর্ক ঐ কর্মের মাধ্যম বা কারণের প্রতি করা হয়। সেটা কোন মানুষের ব্যাপারে হোক, কোন জড় পদার্থের ব্যাপারে হোক, কোন স্থান বা মাখলুক যেমন- (বৃষ্টি, পানি এবং বাতাস এর ব্যাপারে হোক।)

মুশরিকরা বলে “এটা হয়েছে আমাদের ইলাহ্‌দের সুপারিশের বদৌলতে” তারা যখনই কোন জিনিস অর্জন করত তখন তারা বলতো যে এটা আমরা অর্জন করেছি আমাদের ওলী বা নবী বা কোন মূর্তি বা দেবদেবীর কারণে। এসব মুহুর্তে তারা তাদের উপাস্যদের স্মরণ করতো অথচ যিনি এগুলো দান করেছেন সে আল্লাহকে তারা ভুলে যেত অথচ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন শিরকী সুপারিশ কবুল করবেন না যা তারা স্মরণ ও ধ্যান করে থাকে।

আলোচ্য মাস‘লাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাসা‘আলা। লোকদেরকে এর প্রতি সতর্ক করা উচিত, কেননা আমাদের প্রতি আল্লাহর অগণিত নেয়ামত যা গণনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য ফরয ও অপরিহার্য হলো তাঁর নেয়ামতের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকেই সাব্যস্ত করা এবং তাকে স্মরণ ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাঁর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায়ের সবচেয়ে বড় স্তর হলো নেয়ামতের সম্বন্ধ তাঁর দিকেই সাব্যস্ত করা। তিনি তাঁর নবীকে নির্দেশ করেনঃ وَأَمَّابِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ অর্থাৎ “আর তুমি তোমার রবের নেয়ামত সমূহকে বর্ণনা করতে থাক।” অর্থাৎ তুমি বলতে থাক যে, এ হলো আল্লাহর অনুগ্রহে, এটা আল্লাহরই নেয়ামত। কেননা অন্তর যদি কোন মাখলূকের দিকে ধাবিত হয়ে যায় তখন মানুষ শিরকে পতিত হয়ে যায় আর এ শিরক তাওহীদের পরিপূর্ণতার পরিপন্থী। সকল প্রকার নিয়ামত আল্লাহর দিকেই সম্বোধন করা ও তার যোগ্যতা প্রকাশ করা ওয়াজিব। তোমার উচিত হবে যে তুমি বলবে এটা আল্লাহর অনুগ্রহে, এটা আল্লাহর নিয়ামত।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

০১। নেয়ামত সংক্রান্ত জ্ঞান এবং অস্বীকার করার ব্যাখ্যা।

০২। জেনে শুনে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকারের বিষয়টি মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত।।

০৩। মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত এসব কথা আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করারই শামিল।

০৪। অন্তরে দুটি বিপরীতধর্মী বিষয়ের সমাবেশ।

Page- 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

শাইখ আব্দুর রব আফ্ফান- দাওয়াহ ওয়া তাবলীগ ক্লাস, বিষয়- আকিদা (শবেবরাত)-২০, তাং- ১০-৫-২০১৭
শাইখ সাইফুদ্দিন বেলাল মাদানী – DWT class, বিষয়- রাসূলের আনুগত্য- ১৮, তাং- ১৭-০৮-২০১৭
শাইখ সাইফুদ্দিন বেলালা মাদানী- কুরবানী-২০১৭, তাং- ১০-০৮-২০১৭
শাইখ জাকির হুসাইন- দাওয়াহ ওয়া তবলীগ ক্লাস, বিষয়- আরবী ভাষা শিক্ষা-৫, তাং- ২০-১১-২০১৬
শাইখ সাইফুদ্দিন বেলাল – DWT ক্লাস, বিষয়- যিলহজ্জ্ব মাসের ১০ দিনের আমল ও ফযিল, তাং- ১-৮-২০১৭
আহলি সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা, শাইখ সাইফুদ্দিন বেলাল মাদানী
© Dawah wa Tablig since 2013