আভিধানিক অর্থঃ পূর্বের কোন নমুনা ব্যতিরেকে প্রতিটি নতুন আবিস্কারকে বিদাত বলে, চাই তা দ্বীনের মাঝে হোক বা দুনিয়ার বিষয় হোক। আল্লাহর বাণীঃ
“তিনি (আল্লাহ) নবোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের কোন নমুনা ছাড়াই উদ্ভাবক।[সূরা বাকারাঃ ১১৭] আল্লাহ তা‘আলার আরো বাণীঃ “বলুন, আমি তো কোন নতুন রসূল নই।”[সূরা আহকাফঃ ৯] আল্লাহ তা‘আলার আরো বাণীঃ “আমি তার (ঈসা আ:) অনুসারীদের অন্তরে স্থাপন করেছি নম্রতা ও দয়া আর বৈরাগ্য, সে তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে, আমি এটা তাদের উপর ফরজ করিনি, কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এটা অবলম্বন করেছে।”[সূরা হাদীদঃ ২৭]
ইসলামী পরিভাষায় বিদাত হলঃ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ও দ্বীন মনে করে দ্বীনের মধ্যে প্রতিটি নতুন আবিস্কার, যা শরীয়তের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সদৃশ এবং যার আসলে বা গুণাগুনের প্রমাণে কোন বিশুদ্ধ দলিল নেই। [আল-ই‘তিসাম-শাতিবীঃ ১/৩৭] অন্যভাবে বলা যায়, দ্বীনের মাঝে যে সব বিষয়াদি নতুন আবিস্কার যা নবী (সাঃ) ও সাহাবা কেরামের বিপরীত, চাই তা আকীদায় হোক বা আমলে হোক।
এর দ্বারা সুস্পষ্ট হলো যে, দুনিয়াবি যে সব বিষয়াদি নতুন নতুন আবিস্কার হয়েছে বা হচ্ছে কিংবা হবে তা বিদাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং ইসলাম প্রতিটি উপকারী দুনিয়াবী বিষয়ে নতুন আবিস্কারকে উৎসাহিত ও সমর্থন করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ
“তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আলী-বুজর্গদের অনুসরণ করো না।”[সূরা আ‘রাফঃ ৩]
নবী (সাঃ) বলেনঃ “যে কেউ আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিস্কার করে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।”[বুখারী ও মুসলিম]
নবী (সাঃ) আরও বলেনঃ “যে কেউ যে কোন আমল করে যার প্রতি আমাদের সম্মতি নেই তা পরিত্যাজ্য”[মুসলিম] নবী (সাঃ) আরও বলেনঃ “যে কেউ যে কোন আমল করে যার প্রতি আমাদের সম্মতি নেই তা পরিত্যাগযোগ্য।”[মুসলিম] নবী (সাঃ) আরও বলেনঃ “তোমরা (দ্বীনের মাঝে) নতুন আবিষ্কার জিনিস থেকে বিরত থাক। নিশ্চয় (দ্বীনের মধ্যে) প্রতিটি নতুন আবিষ্কার বিদাত এবং প্রতিটি বিদাতই ভ্রষ্ট ও প্রতিটি ভ্রষ্টের ঠিকানা জাহান্নাম।”[নাসাঈ]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ অনুসরণ কর, বিদাত কর না। কারণ পূর্ববর্তীরা তোমাদের জন্য যথেষ্ট করে দিয়েছে। হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ প্রতিটি ইবাদত যা মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবাগণ করেননি তা কর না। কারণ তাঁরা পরবর্তীদের জন্য কিছুই ছেড়ে যাননি। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ প্রতিটি বিদাতই ভ্রষ্ট যদিও মানুষ তাকে হাসানাহ তথা উত্তম মনে করে। উমার ইবনে আব্দুল আজীজ (রহঃ) বলেনঃ যেখানে পূর্বের জাতি [নবী (সাঃ) ও সহাবীগণ] দাঁড়িয়ে গেছেন সেখানেই দাঁড়ানো ওয়াজিব। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি বিদাত আবিষ্কার করে তাকে হাসানাহ তথা উত্তম ধারণা করে, নিশ্চয় সে মুহাম্মদ (সাঃ) কে রেসালাতের খেয়ানতকারী সাব্যস্ত করে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা মায়েদাঃ ৩] ইমাম আওজা‘য়ী (রহঃ) বলেনঃ তুমি সালাফদের (সহাবী ও তাবেঈ) পদাঙ্ক অনুসরণ কর যদিও মানুষ তোমাকে বর্জন করে। আর মানুষদের মাতমত পরিহার কর যদিও তাকে তারা চাকচিক্য ও সজ্জিত করুক না কেন।
বিদাতের প্রকারঃ দ্বীনের মাঝে বিদাত দুই প্রকারঃ
প্রথমঃ আকিদাতেঃ
আকীদাতে বিভিন্ন ধরনের বাতিল উক্তির বিদাত। যেমনঃ জাহমিয়্যা, মু‘তাজিলা, রাফেযা ও সমস্ত পথভ্রষ্ট দল ও তাদের আকীদা সমূহ।
দ্বিতীয়তঃ ইবাদতেঃ
যে বিদাত ইবাদতের মধ্যে করা হয়। ইহা আবার দুই প্রকারঃ
“হাকিকী বিদাত” যা ইবাদতে মধ্যে হয়। ঐ সব ইবাদত যা নতুনভাবে যোগ করা হয়েছে শরিয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। যেমনঃ ঈদে মীলাদুন্নবী।
“ইযাফী বিদাত” যে কোন বৈধ ইবাদতের মাঝে অতিরিক্ত সংযোগ করা হয়। ইহা আবার কয়েক প্রকারঃ
ইবাদতের প্রাকারে। যেমন- মহিষ দ্বারা কুরবানি করা।
ইবাদতের কারণে। যেমন- শবে মেরাজের রাতে ইবাদত করা।
ইবাদতের পদ্ধতিতে। যেমন- যৌথকণ্ঠে জিকির ও দোয়া কিংবা আখেরী মোনাজত করা।
ইবাদতের সময় নির্ধারণে। যেমন: ১৫ শাবানের রাতের সালাত আদায় ও দিনের রোজা রাখা।
ইবাদতের সংখ্যায়। যেমন: দোয়া ইউনুস এক লক্ষবার খতম পড়া।
ইবাদতের স্থান নির্ধারণে। যেমন: মসজিদ ছাড়া বাড়িতে ইতেকাফ করা।
বিদাতের বিধানঃ
দ্বীনের মাঝে সকল প্রকার বিদাত হারাম ও ভ্রষ্ট। নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) সকল প্রকার নতুন জিনিস থেকে সাবধান থাক। কারণ, (দ্বীনের মাঝে) প্রতিটি নতুন বিদাত এবং প্রতিটি বিদাত এবং প্রতিটি বিদাতই ভ্রষ্ট।” [সহিহুল জামে’-আলবানী হাঃ ২৫৪৬]
নবী (সাঃ) এর আরো বাণীঃ “যে কেউ আমাদের দ্বীনের মাঝে নতুন কিছু আবিস্কার করবে যা তার অন্তর্ভুক্ত না, তা পরিত্যাজ্য।” [বুখারী হাঃ ২৬৯৭ ও মুসলিম হাঃ ১৭১৮] আরো তাঁর বাণীঃ “যে কেউ যে কোন আমল করবে যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা তা অগ্রহণযোগ্য।” [মুসলিম হাঃ ১৭১৮ ও ১৮]
এসব হাদীস প্রমাণ করে যে, দ্বীনের মধ্যে প্রতিটি নতুন জিনিস বিদাত। আর প্রতিটি বিদাত ভ্রষ্ট ও অগ্রহণযোগ্য। এর অর্থ এই যে, বিদাত চাহে ইবাদতে হোক বা আকীদাতে হোক সবই হারাম। তবে হারামের স্তর বিদাতের প্রকার হিসেবে তফাত হবে।
এগুলোর মধ্যে কিছু আছে সুস্পষ্ট কুফুরী পর্যায়েরঃ
যেমনঃ কবরের পার্শ্বে কবরবাসীর নৈকট্য লাভের আশায় তওয়াফ করা, কুরবানি করা, নজর-নিয়াজ পেশ করা, তাদেরকে আহবান করা ও বিপদ মুক্তির জন্য ডাকা। অনুরূপ সীমালঙ্ঘনকারী জাহমিয়্যা ও মু‘তাজিলা সম্প্রদায়ের বাতিল আকীদাসমূহ।
আর কিছু আছে শিরকের মাধ্যমঃ
যেমনঃ কবরের উপর ঘর বানানো ও সেখানে সালাত কায়েম করা।
আর কিছু আছে যা সঠিক আকীদার বিপরীতঃ
যেমনঃ খারেজী, কাদারী ও মুর্জিয়া সম্প্রদায়ের কথায় ও আকীদার মাঝে শরিয়তের দলিলের বিপরীত বিদাতসমূহ।
আর কিছু আছে যেগুলো পাপ পর্যায়েরঃ
যেমনঃ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য খাশী হয়ে যাওয়া, সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে রোজা পালন করা ও বৈরাগী হওয়া।
নোটঃ বিদাতকে হাসানাহ ও সাইয়িআহ ভাগ করা একটি জঘন্য অপরাধ। কারণ, নবী (সাঃ) প্রতিটি বিদাতকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। চাই তা আকীদাতে হোক বা আমলে বা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কথায় হোক সবই গুমরাহ ও তা হতে দ্বীন সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
বিদাত সৃষ্টির কারণ সমূহঃ
দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা।
প্রবৃত্তির গোলামি।
রূপক অর্থের আয়াত ও হাদীসের অনুসরণ।
বিজাতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার অনুকরণ।
নবী-রসূল, অলি-বুজুর্গ ও নেক ব্যক্তিদের নিয়ে অতিরঞ্জন বাড়াবাড়ি।
অসীম জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ প্রদত্ত কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের উপর সসীম জ্ঞানের আধিকারী অজ্ঞ মানুষ নিজের স্বভাবজাত বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়া।
নিজের রুচি দ্বারা দ্বীনকে মানা।
মাজহাবী পক্ষাপাতিত্ব ও গোঁড়ামি।
অন্ধ ব্যক্তি পূজা।
জাল ও দুর্বল হাদীস সমূহ।
শারিয়তের সঠিক জ্ঞান ও তাহকীক ছাড়া ফতোয়াসমূহ।
অতি সহজে জান্নাতে যাওয়ার পথ তালাশ।
বিবিধ।
বিদাত প্রচার ও প্রসার লাভের কারণ সমূহঃ
সাধারণ মানুষকে বিদাত করতে দেখার পরেও এক শ্রেণীর আলেমদের নিরবতা পালন।
সরকার বাহাদুরের সহযোগিতা।
জাল ও দুর্বল হাদীসের বহুল প্রচার।
কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের ব্যাপক প্রচার-প্রসার না হওয়া।
না জেনে বা ভুল কিংবা কারণ বশত: কোন আলেমের বিদাত করা।
বিদাতের পরিণামঃ
(ক) দুনিয়াতেঃ
বাতিল আকীদা বা কুফুরী পর্যায়ের হলে দ্বীন থেকে খারিজ।
পথভ্রষ্ট ও গুমরাহী।
কুফুরী ও শিরকে বা বালা-মুসিবতে পতিত হওয়া।
হক তথা কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীস গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকা।
আহালূসসুন্নাহ ওয়ালজামাত তথা হকের সাথে দুশমনি ও সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হওয়া।
অমুসলিমদের সাথে সদৃশ।
ধন-সম্পদের অপচয় ও দলাদলি সৃষ্টি।
আপোসে অনৈক্য ও দলাদলি সৃষ্টি।
শক্তি খর্ব।
বিদাতীর কোন সাক্ষী গ্রহণ করা হবে না।
বিদাতী অভিশপ্ত।
বিদাতী আল্লাহ হতে দূরে হয়ে যায়।
বিদাতীর আমল কবুল হয় না।
(খ) আখেরাতেঃ
বিদাতী নবী (সাঃ) এর হাউজে কাওছার থেকে বিতাড়িত হবে।
বিদাতী নবী (সাঃ) এর হাউজে কাওছারের পানি পান করা থেকে বঞ্চিত হবে।
বিদাতী কিয়ামতে নবী (সাঃ) এর শাফা‘আত থেকে মাহরুম হবে।
বিদাত সৃষ্টিকারী ওস্তাদের দেখে বিদাতকারীদের সকলের সমান পাপ তার ঘাড়ে বোঝা চাপবে।
জাহান্নামে প্রবেশ।
বিদাতীদের আলামত বা লক্ষণঃ
ফির্কাবন্দী ও দলাদলি করা।
প্রবৃত্তির গোলামি করা।
রূপক আয়াত ও হাদীসের অনুসরণ করা।
কুরআন দ্বারা হাদীসের সাথে দ্বন্দ্ব করা।
আহলুল হাদীসের সাথে দুশমনি ও তাদেরকে ঘৃণা করা।
আহলুসসুন্নাহ ওয়ালজামাতকে বিভিন্ন খারাপ উপাধিতে ভূষিত করা।
সালাফে সালেহীনের পথকে গ্রহণ না করা।
দলিল ছাড়া তাদের বিপরীতকারীদের কাফের ফতোয়া দেওয়া।
পক্ষের হলে গ্রহণ করা এবং বিপক্ষের হলে বর্জন করা।
ইচ্ছামত কুরআন ও হদীসের অপব্যাখ্যা করা।
যা বিদাতের অন্তর্ভুক্তঃ
সুন্নতের বিপরীত প্রতিটি জিনিসই বিদাত, চাই তা কথা, বা কাজ কিংবা আকীদা হোক। এ ছাড়া যদিও তা কোন আলেমের গবেষণা হোক না কেন।
শরিয়তে নিষিদ্ধ প্রতিটি এমন জিনিস যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন উদ্দেশ্য হয়।
প্রতিটি এমন জিনিস যা শরিয়তের দলিল ছাড়া বৈধকরণ অসম্ভব। কিন্তু কোন সাহাবী থেকে হলে তা বিদাত অন্তর্ভুক্ত হবে না।
অমুসলিমদের যে সব আচার-অনুষ্ঠান ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আলেমরা যে সব জিনিসকে কোন দলিল ছাড়াই মস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। আর বিশেষ করে পরবর্তী যুগের আলেম সমাজ যা করেছেন।
যে সব ইবাদতের পদ্ধতি দুর্বল ও জাল হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে।
ইবাদতে অতি রঞ্জন বাড়াবাড়ি করা।
এমন প্রতিটি ইবাদত যাকে শরিয়ত সাধারণ রেখেছে কিন্তু মানুষ তা বিশেষ স্থান বা সময় কিংবা পদ্ধতি অথবা সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট করেছে। [আহকামুল জানায়েজ-শাইখ আলবানী (রহ:) দ্রষ্টব্য।]
বিদাত থেকে বাঁচার উপায় কি?
বেশ বেশি কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীস সালাফে সালেহীনের বুঝে অধ্যায়ন করা।
বিদাত ও বিদাতীদের বিষয়ের বই-পুস্তক পড়া।
বিদাতীদের লিখা বই-পত্র পড়া-শুনা থেকে দূরে থাকা।
বিদাতী ব্যক্তি, দল ও সংগঠনসমূহকে চিহ্নিত করা ও সাবধান থাকা।
দুনিয়া ও আখেরাতে বিদাতের পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা।
জানার সাথে সাথে বিদাত পরিত্যাগ করা এবং মনে কোন সন্দেহ ও সংশয় না করা।
বিদাত মুক্ত সমাজে বসবাস করা।
প্রয়োজনে বিদাতী সমাজ ছেড়ে হিজরত করা।
কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের অধিক প্রচার ও প্রসার করা।
বিদাতীদের সাথে উঠা-বসা, লেনদেন ও আত্মীয়তা না করা।
প্রচলিত কিছু বিদাতঃ
মুখে নিয়ত পড়া।
ফরজ সালাতের পর বা মাহফিল কিংবা এজতেমা শেষে সকলে মিলে একসাথে
যৌথকণ্ঠে জিকির বা হজ্বের তালবিয়া পাঠ করা।
ওযুতে প্রতিটি অঙ্গের জন্য বিশেষ দোয়া পড়া ও ঘাড় মাসেহ করা।
মীলাদুন্নবী ও বিভিন্ন ধরনের দিন বা বার্ষিকী পালন করা।
শবে মিরাজের অনুষ্ঠান মানা।
শবে বরাত পালন করা।
বিভিন্ন প্রকার খতম পড়া বা পড়ানো।
বিভিন্ন প্রকার তরীকার জন্ম।
পীর-মুরিদী ও খানকার ব্যবসা।
বিবিধ।
[নোটঃ যদি এ সমস্ত কাজে কল্যাণ থাকত, তবে নবী (সা:) ও তাঁর পরে সাহাবা কেরাম (রা:) অবশ্যই আমাদের পূর্বে তা করতেন। অতএব, যদি আল্লাহ ও তাঁর নবী (সা:) কে মহব্বত করেন, তাহলে একমাত্র দ্বীনের হিদায়াতের অনুসরণ করুন এবং সর্বপ্রকার বিদাত থেকে দূরে থাকুন।]
জাহিলিয়াত
(ক) জাহিলিয়াতের অর্থঃ “জাহল” আরবী শব্দ যার অর্থ অজ্ঞতা। আর অজ্ঞ ব্যক্তিকে বলে “জাহিল” তথা মূর্খ। ইসলাম পূর্বযুগকে জাহিলিয়াত বলা হয়। কারণ সে যুগে মানুষ আল্লাহ, রসূল ও শরিয়াতের বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ ও মূর্খ ছিল।
(খ) জাহিলিয়াতের প্রকারঃ
সাধারণ জাহিলিয়্যাতঃ ইহা নবী (সা:) এর আবির্ভাবের পূর্বযুগকে বলা হয়। এ যুগ তাঁর নবুওয়াত ও রিসালতের পরে শেষ হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোন যুগ বা শতাব্দিকে সাধারণভাবে জাহিলিয়াতের যুগ বলা যাবে না।
বিশেষ জাহিলিয়্যাতঃ ইহা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা দেশ কিংবা শহর অথবা কাজকে বলা যেতে পারে। যেমন: নবী (সাঃ) বলেন: “আমার উম্মতে জাহেলিয়াতের চারটি কাজ।” [মুসলিম] রসূলুল্লাহ (সাঃ) আবু যার গিফারীকে বলেনঃ “তোমার মাঝে জাহিলিয়াতের গুণ রয়েছে।”
(গ) ইসলাম ও জাহিলিয়াতের যেসব বিষয়ে দ্বন্দ্বঃ পৃথিবীতে হাতে গণা কিছু আহলি কিতাব ছাড়া আরব-অনারব সমস্ত জমিনবাসী বিবেকের উপর তালাবদ্ধ করে, চক্ষু থাকতে অন্ধ হয়ে সিরাতে মুস্তাকীম ছেড়ে শয়তানের পথ ধরেছিল। আর দ্বীন-দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের অশান্তি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জাহিলিয়াতের ঘন অন্ধকারে ভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঠিক এমন সময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন পথহারা, দিশাহারা বরবর মানুষদেরকে হিদায়াতের জন্য শেষ নবী রহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মদ (সা:) কে এ ধরাধামে জাহিলিয়াতের সকল রসম ও রিওয়াজ উৎখাত করে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রেরণ করেন।
তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর অবিরাম আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত ও কুরআন-সুন্নার তাবলীগ করে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্ত করেন এবং সর্বপ্রকার জাহিলিয়াতের রসম ও রিওয়াজ থেকে সাবধান এবং সেগুলোর সাথে সদৃশতা ও ঐক্যমত পোষণ করতে বারণ করেন। এ ছাড়া উম্মতকে আল্লাহর মনোনীত পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলামের সত্যের উপর রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।
কিন্তু মুসলিম জাতি যুগ-যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে মানব-দানব শয়তানের ফাঁদে পড়ে ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের অদ্ভুত, অলৌকিক, অস্বাভাবিক ও চমকপ্রদ কার্যকলাপের গোলক ধাঁধায় আটকা পড়ে এবং হিরা গুহা থেকে বিকশিত অহীর জ্ঞান থেকে দূরে সরে প্রাচীন জাহিলিয়াতের সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে যে, দেখে মনে হয় সে যুগের জাহিলিয়াতকে এ যুগের কিছু জাহিলিয়াত হার মানিয়েছে।
বর্তমানে ইসলাম ও নব জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। জাহিলী যুগের যে সকল বিষয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে দ্বন্দ্ব হয়েছিল এবং তিনি তার সাথে বিরোধিতা করেছিলেন, আজ আবার সেগুলো আমাদের মুসলিম সমাজকে মহামারীর মত গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সঠিক ইসলাম এবং বিভিন্ন ধর্ম ব্যবসায়ী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের বানানো ইসলামের মধ্যে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। এ সব প্রত্যেকটি মুসলিমের জন্য জানা একান্ত প্রয়োজন। কেননা নকল বস্তু সম্পর্কে জানা থাকলেই কেবল আসল সব্স্তু চেনা সম্ভব হয়। আপনাদের সমীপে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব ১০৫ টি বিষয় উল্লেখ করা হলো। আশা করি ইহা সঠিক ভাবে জানলে নিজেকে পরিবারকে, সমাজ ও মুসলিম মিল্লাতকে জাহিলিয়াতের অক্টোপাস্ থেকে নিষ্কৃতি দান করা যাবে।
আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর নিকট সুপারিশের উদ্দেশ্যে নেককার-বুজুর্গদের ধরা বা আল্লাহর ইবাদত না করে এই সব নেককার-বুজুর্গদের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা।
দলাদলি ও অনৈক্যতা।
শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা করা।
তাকলীদ তথা ব্যক্তির অন্ধ পূজা।
ফাসেক আলেম ও মূর্খ দরবেশদের অনুসরণ করা।
বাপ-দাদাদের দোহাই দেয়া।
গণতন্ত্র তথা সংখ্যা গরিষ্ঠতার দোহাই দেয়া বাতিলকে সত্য বলা।
সংখ্যা গরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে সত্যকে পরিহার করা।
শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার ধোঁকা।
অফুরন্ত ধন-সম্পদের মালিক হওয়া আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার লক্ষণ মনে করা।
সত্যপন্থীগণ দূর্বল হওয়ার কারণে মূল সত্যকেই অবজ্ঞা করা।
সত্যপন্থীদের উপর মিথ্যা দোষারোপ করা।
হকপন্থীগণ দূর্বল বলে হকপন্থীদেরকে সাহায্য না করা
নিজেদেরকে বেশী যোগ্য ভেবে অন্যদের সত্যকে বাতিল মনে করা।
সত্য থেকে বিমুখ হওয়া এবং ধারণা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করা।
সঠিক কিয়াসেকে অস্বীকার ও ত্রুটিপূর্ণ কিয়াসকে গ্রহণ করা।
আলেম ও সৎ লোকদের ব্যাপারে অতিরঞ্জন-বাড়াবাড়ি করা।
না বুঝার অজুহাত দেখানো।
দলীয় নীতির বিরোধী হওয়ায় সত্যকে অস্বীকার করা।
যাদুর অলৌকিক ক্রিয়া-কাণ্ডকে অভ্রান্ত দলিল হিসাবে গ্রহণ করা।
বংশ সম্বন্ধ পরিবর্তন করা।
আল্লাহর কালামের মূল বক্তব্য হেরফের করা।
দ্বীনী কিতাবসমূহে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা।
আল্লাহর অলি ও শয়তানের অলির মধ্যে পার্থক্য না করা।
দুনিয়ার সার্থে সম্পর্ক গড়া ও বিচ্ছিন্ন করা।
দ্বীনের হিদায়াত ছেড়ে দ্বীন বিরোধী পথে অনুগমন করা।
অন্যের অনুসৃত সত্যকে অস্বীকার করা।
প্রত্যেক দলের এই দাবী করা যে, সত্য কেবল তার মাঝেই নিহিত।
দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত জেনেও তা অস্বীকার করা।
নগ্নতার প্রদর্শনী।
হালাল বস্তুকে হারাম করে নিয়ে ইবাদতে লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বিকৃত করা।
স্রষ্টা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ হতে সৃষ্টজীবের বিরত থাকা।
আল্লাহর প্রতি বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি আরোপ করা।
নাস্তিক্যবাদ।
আল্লাহর মালিকানায় শরীক করা।
সমস্ত নবুওয়াতকে অস্বীকার করা।
তাকদীরকে অস্বীকার করা।
যুগ জামানাকে গালি দেওয়া।
আল্লাহর নিয়ামত সমূহকে অন্যের দিকে সম্পর্কিত করা।
আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করা।
বাতিল বই-পত্র পড়াশুনা করা এবং আল্লাহর আয়াতসমূহকে দূরে নিক্ষেপ করা।
আল্লাহর পরিকল্পনাকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করা।
ফিরিস্তাগণ ও রসূলগণকে অস্বীকার করা এবং তাঁদের মধ্যে পার্থক্য করা।
নবী ও রসূলগণের ব্যাপারে অতিরঞ্জন বাড়াবাড়ি করা।
না জেনে-বুঝে ঝগড়া করা।
দ্বীনের ব্যাপারে না জেনে-বুঝে কথা বলা।
না জেনে-বুঝে আল্লাহ সম্পর্কে কথা বলা।
কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করা।
“আল্লাহ বিচার দিনের মালিক”এই আয়াতকে মিথ্যা মনে করা।
“কিয়ামতের দিন কোনরূপ বন্ধুত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগবে না” এ আয়াতকে মিথ্যা মনে করা।
শাফাআতের ভুল অর্থ গ্রহণ করা।
আল্লাহর অলিদেরকে হত্যা করা।
জিবত্ (প্রতিমা) ও তাগুত (শয়তান) এর উপর ঈমান আনা।
সত্যের উপরে মিথ্যার আবরণ দেওয়া।
পীর-বুজুর্গদের শরিয়ত বিরোধী আনুগত্য করে রব বানিয়ে নেয়া।
সত্যকে প্রতিরোধ করার জন্য সাময়িকভাবে তাকে স্বীকার করে নেওয়া।
নবী-রসূলগণকে আল্লাহর আসন দান করা।
আল্লাহর কিতাবের শব্দসমূহকে বিকৃত করা।
হিদায়াতপ্রাপ্ত লোকদেরকে অভিনব উপাধিসমূহ দ্বারা অভিহিত করা।
সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
মুমিনদের উপর মিথ্যারোপ করা।
মুমিনদের বিরুদ্ধে ধর্ম পরিবর্তনের অভিযোগ করা।
হক পন্থীদের বিরুদ্ধে সরকারের নিকট কু-পরামর্শ দেওয়া।
সত্য বিচ্যুতির ফলে দলে দলে বিভক্তি হওয়া।
নিজেদের লালিত মতবাদকে হক মনে করে তার উপর আমল বজায় রাখার দাবী করা।
ইবাদতের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা।
ইবাদতে কমতি করা।
ইবাদতের উদ্দেশ্যে রুচিকর খাদ্য ও সৌন্দর্য ত্যাগ করা।
মুখে শিস ও হাতে তালি দিয়ে ইবাদত করা।
আক্বীদা বিশ্বাসে মুনাফেকী।
ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করা।
জেনে-শুনে কুফুরী দিকে আহ্বান করা।
সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য বড় ধরনের মক্করবাজি করা।
হককে গ্রহণ না করার উদ্দেশ্যে ছল-চাতুরী করা।
বদকার আলেম ও মূর্খ দরবেশদের জঘন্য অবস্থা।
নিজেদেরকে কেবল আল্লাহর অলি ধারণা করা।
শরিয়ত ত্যাগ করে আল্লাহর মহব্বতের দাবি করা।
আল্লাহর উপর কাল্পনিক মিথ্যা আশা করা।
নেককার ও অলিদের কবরকে মসজিদে পরিণত করা।
নবী-রসূলদের স্মৃতিচিহ্নসমূহে মসজিদ তৈরি করা।
কবরে বাতি দেওয়া বা জ্বালানো।
কবরকে মেলা-উৎসবের স্থান পরিণত করা।
কবরের পার্শ্বে পশু জবাই করা।
বড় বড় নিদর্শনসমূহ দ্বারা বরকত কামনা করা।
প্রতিপত্তির অহঙ্কার করা।
বিভিন্ন তারা গণনার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা।
বংশ উল্লেখ করে তিরস্কার করা।
কারো মৃত্যুর পর বিলাপ করে কান্না করা।
বাপ-মায়ের কর্ম দ্বারা কাউকে তিরস্কার করা।
কোন বিশেষ ঘরের তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার গর্ব করা।
নবী বংশ থেকে হওয়ার গর্ব করা।
পেশার অহংকার করা।
ধন-সম্পদের অহঙ্কার করা।
দরিদ্রদের ঘৃণা করা।
অহি ও রেসালতকে অস্বীকার করা।
জানা সত্বেও সত্য গোপন করা।
স্ববিরোধীতা করা।
মাজহাবী গোঁরামী ও স্বদলীয় প্রীতি প্রদর্শন।
পাখী উড়িয়ে ভালমন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
ফাঁদ পাতা ও তাবিজ দ্বারা ঘর-বাড়ি বন্ধ করা ইত্যাদি।