আল হামদুলিল্লাহ ওয়াস স্বলাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ আম্মাবাদ:
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলেম উলামা যে ধরণের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তারই অংশ হিসাবে দু’চার কথা লেখা প্রয়োজ মনে করছিলাম। ইতিমধ্যে কয়েক জন দ্বীনী ভাইর আবেদন আসায় বিষয়টির সম্পর্কে কলম ধরা আরও জরুরি হয়ে পড়লো।
ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে সব আলেম উলামার বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সকলে মূর্তী পূজা শিরক বলে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন। আর ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম এতেও প্রায় ঐক্যমতে উপনিত হয়েছেন। যদিও স্রেফ ভাস্কর্য নির্মাণ শিরক না শিরকের উপকরণ তা নিয়ে অনেকে মতভেদ করেছেন। তবে এতে সন্দেহ নেই যে তা শিরকের মাধ্যম ও উপকরণ। এবার বুঝার বিষয় হলো, কেন মূর্তী ও ভাস্কর্য নির্মাণ, সংরক্ষণ ও এ সবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যাবে না? এর উত্তরে হয়তো আমরা সকলে একমত প্রকাশ করবো যে, কারণ এসব হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত বা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা-পূজাপাট যা শিরক এবং ইসলাম কঠোর ভাবে শিরক করা নিষেধ করেছে। তাই মূর্তী ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে দেশে শিরকের আমদানী করা যাবে না। তাওহীদী জনতা তাওহীদের উপর থাকবে শিরকের উপর থাকতে পারে না। তাই আন্দোলন হবে, মিছিল হবে এবং শেষ শক্তি থাকা পর্যন্ত এর বিরোধিতা হবে।
চমৎকার দ্বীনী জযবা এবং অতিউত্তম যুক্তি। “আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করা যাবে না”। এখন প্রশ্ন হলো, ভাস্কর্য নির্মাণ হলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত হওয়ার আশংকা আছে বা তাকে সম্মান প্রদর্শন করলে শিরক হয়। এ কারণে যদি এর বিরোধিতা জরুরী হয়, তাহলে দেশে বরং উপমহাদেশে হাজার হাজার এমন স্থান রয়েছে যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত হয়। কম করে হলে সে সব স্থান শিরকের মাধ্যম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সম্পর্কে আমরা উদাসীন কেন? সে ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আন্দোলন নেই কেন? কোনো প্রচেষ্টা নেই কেনো? আর যারা কিছুটা আন্দেলন করে থাকেন তাদের পাশেও আমরা দাঁড়াই না কেন? এসব প্রশ্ন উত্থাপন সঙ্গত হয়ে পড়ে।
#মাযার-দরগাহে যখন বাবার সন্তুষ্টি ও তার অসীলা পাওয়ার উদ্দেশ্যে যবাই করা হয়, নযর-মান্নত দেওয়া হয়, তখন সেটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত হয় না কি?
#মাযার-দরগাহে যখন বিনম্রতার সহিত রুকু, সাজদা করা হয় এমনকি কবরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করা হয়, তখন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত শিরক হয় না কি?
#কবরস্থ অলীর নিকট যখন দুআ করা হয়, প্রার্থনা করা হয়, আশা করা হয়, কামনা করা হয়, তখন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত হয় না কি?
#দু:খ-কষ্ট এবং বালা মুসীবতে পড়লে নামধারী মুসলিম যখন সেই সব খাজা বাবা, পীর বাবা, অলী বাবার নিকট কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ জানায়, তখন এটা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত হয় না কি?
#ভাস্কর্যকে সম্মান জানালে শির্ক হয় কিন্তু যখন কেউ এ কথা বলে যে আমার পীরের নাম বিনা অযুতে নেওয়া যাবে না, তখন এখানে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সম্মান প্রদর্শন হয় না কি? আল্লাহ বা তার রাসূলের নাম নিতে অযু দরকার হয় না কিন্তু তার খাজা বাবার নাম নিতে অযুর প্রয়োজন হয়!
#ভাস্কর্যকে সম্মান জানালে শির্ক হয় কিন্তু দরগাহে আদবের সাথে সম্মানের সাথে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়, ফিরে আসার সময় তার দিকে পাছা করে ফেরা যাবেনা তাই উল্টা পায়ে ফেরত আসতে হবে। এসব তখন শির্ক হবে না কি?
ভাস্কর্যে ফুলের মালা দিলে যদি শিরক হয়, তাহলে কবরে ও মাযারে ফুল ও চাদর দিলে শির্ক হবে না কেন?
তাই বলছিলাম, মূতী ও ভাস্কর্যের শিরক আমরা চিনতে পারলাম কিন্তু অন্যান্য শির্ক চিনতে পারলাম না। সত্যিকার অর্থে আমরা অনেকে (যাদের আলেম মনে করা হয়) বাহ্যিক মূর্তী পূজা তথা প্রতীমা পূজাকেই শুধু শিরক মনে করি অন্য কিছুকে শির্ক মনে করি না। অথচ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের যাবতীয় ইবাদতই হচ্ছে শিরক। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হচ্ছে তাওহীদ। আর একমাত্র আল্লাহর ইবাদত না হয়ে যদি তার সাথে অন্যের ইবাদত হয় তাহলে সেটাই তো শিরক। আর সেটা হচ্ছে ইবাদতে শিরক, যা বুঝাতে যুগে যুগে নবী এবং রাসূলগণ প্রেরীত হয়েছেন এবং সকল নবী তাঁদের জাতিকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করতে নিষেধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
(وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ)
(আমি তোমার পূর্বে এ অহী ছাড়া কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো (সত্য) উপাস্য নেই, সুতরাং তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো।) [সূরা আম্বিয়া আয়াত নং ২৫]
মহান আল্লাহ আরও বলেন:
(وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ)
(অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগূত থেকে দূরে থাকো।) [সূরা নাহল, আয়াত নং ৩৬]
তাই আমাদের সকলের প্রথম কর্তব্য হবে শির্ককে ভালভাবে জানা, চেনা ও বুঝার। অত:পর এর বিরুদ্ধে ব্যাপক দাওয়াত ও তাবলীগের, যার পরিসর সাধারণ ব্যক্তি থেকে সরকার পর্যন্ত। তারপেই শিরক সমূলে উৎপাটন হবে। শিরকও উৎখাত হবে এবং শিরকের উপকরণও ধংস হবে। নচেৎ এটা হাস্যকর যে, একদিকে আমরা শিরকের মাধ্যম ও উপকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছি আর অন্য দিকে হাজার হাজার বড় শিরকের আখড়াকে বেমালুম ভুলে যাচ্ছি, সে সবের বিরুদ্ধে কোনো শব্দও করি না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসলামে মূর্তী, ভাস্কর্য, প্রতীমা নির্মাণ এমনকি প্রাণীর ছবি অঙ্কন হারাম তথা নিষেধ। আর এসবের ইবাদত উপাসনা করা মহাপাপ শিরক। শুধু এসব নয় বরং আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাই হোক না কেন, তা সম্মানিত ফেরেশতাকুল হোক কিংবা সম্মানিত নাবী রাসূলগণ হোন কিংবা অলী-আউলিয়া হোক, জীব জগত হোক বা জড় জগত হোক, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত-উপাসনা মাত্রই শিরক বলে গণ্য। আর ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম, তা শিরকের মাধ্যম। ভাস্কর্যে মাল্যদান বিজাতীয় নিষিদ্ধ প্রথা। এটা তখন বড় শির্কে রুপান্তরিত হবে যখন এতে ইবাদতের তিনটি রুকন একত্রিত হবে। অর্থাৎ ভাস্কর্যকে মাল্যদান বা সম্মান প্রদর্শনের সময় যদি মাল্যদাতার অন্তরে ভাস্কর্যের ভয়, তার ভালবাসা ও তার কাছে কিছু পাওয়ার আশা একত্রিত হয়, তাহলে তখন তা বড় শির্কে পরিণত হবে।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ইসলামে প্রাণী ছাড়া অন্য কিছুর ভাস্কর্য নির্মাণ জায়েয।